“স্কুল, কলেজ কি রাজনৈতিক দলের তাবেদার?“ “রাজনৈতিক সভার জন্য কি পরীক্ষা বাতিল করা যায়?” “হাজার হাজার ছাত্র–ছাত্রীর ভবিষ্যৎ কি তবে থেমে যেতে পারে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসের কাছে? – এই সমস্ত প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিলেন কেবল একজন মহিলা শান্তা দত্ত দে (Shanta Dutta Dey)। তিনি একাই কাবু করে দিলেন তৃনমূলকে ও রাজ্য সরকারকে! মুখ্যমন্ত্রী মমতার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে করলেন এমন কাজ যা তৈরি করল দৃষ্টান্ত।
কিন্তু কে এই শান্তা দত্ত দে ? কীভাবে তিনি একাই কাবু করলেন রাজ্য সরকারকে? চলুন আজ এক এক করে জেনে নেয়া যাক সমস্ত তথ্য।
দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে পরীক্ষা?
২০২৫ সালের ২৮শে আগস্ট একদিকে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবস এবং অন্যদিকে স্নাতক স্তরের পরীক্ষা, আর এই নিয়েই ধুন্ধুমার হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু এর শুরুটা এক দিনে হয়নি, হয়েছে গত এক মাস ধরে।
দিনটা ২০২৫ সালের ২৪শে জুলাই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে স্নাতক স্তরের ৪র্থ সেমিস্টারের পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বিভিন্ন তারিখের পাশাপাশি ২৮শে আগস্ট তারিখেও বি.এ, বি.কম পরীক্ষার্থীদের কিছু পরীক্ষার দিন ধার্য করা হয়। আর তার পর থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক গর্জন।
২৬শে জুলাই এই বিষয়টি নিয়ে প্রথম গর্জে ওঠেন তৃণমূল ছাত্র পরিষেদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। তিনি ফেসবুকে একটি লম্বা পোস্ট লেখেন, তবে তার সারমর্ম হল, “আজ ছাত্র-যুব সমাজ যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিশ্বাসী, তাঁদের আটকে দেওয়ার জন্য এক গভীর ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়েছে। আগামী ২৮ আগস্ট, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে হঠাৎ করে B.Com সেমিস্টার 4 এবং B.A.LLB সেমিস্টার 4-এর পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করা হয়েছে এবং সময় দেওয়া হয়েছে ঠিক দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫টা। এটি কোনো সাধারণ অ্যাকাডেমিকসিদ্ধান্ত নয়। এটি ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেওয়া এবং দিল্লির ইশারায় চলা একটিরাজনৈতিক অপকৌশল।’ শুধু তাই নয় ওই পোস্টে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্ত দে-কে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলেও অভিহিত করেন তৃণাঙ্কুর।
পরে, শান্তা দত্ত দে জানান, “এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনার তারিখ মাথায় রেখে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পরীক্ষা কেবল সরকারিছুটির দিনেই অনুষ্ঠিত হয় না।”
এরপর ২৮শে জুলাই, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ-এর সদস্যরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করেন। ঘেরাওয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে কর্তৃপক্ষ।
এরপর ১লা আগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে একটি সংশোধিত পরীক্ষার কর্মসূচী প্রকাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু, এবারেও আশায় জল পড়ে তৃণমূল নেতৃত্বদের। কারণ টেকনিক্যাল এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কারণ দেখিয়ে কয়েকটি পেপারের তারিখ পরিবর্তন করা হলেও অপরিবর্তিত রাখা হয় ২৮শে আগস্ট পরীক্ষার দিনটিকে।
এরপরের দিন অর্থাৎ ২রা আগস্ট, ক্ষুব্ধ তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে নেওয়া হয় একটি গুরুতর পদক্ষেপ। উচ্চশিক্ষা দপ্তরের তরফ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়, “২৮শে আগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভা রয়েছে। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা ফেলায় বেশ কিছু পড়ুয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অসুবিধের কথা জানিয়ে। আপনাদের অনুরোধ করা হচ্ছে ওই পরীক্ষা রিশিডিউল করার জন্য।“
যার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা শান্তা দত্ত দে জানান, “অনেক ভাবনা–চিন্তা করে এই ডেট ফেলা হয়েছে। তা রিশিডিউল করা সম্ভব নয়। তৃণমূল সুপ্রিমো বা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের উচিত ছিল আমাকে চিঠি না পাঠিয়ে নিজেদের ছাত্র সংগঠনকে বলা যে, “তোমাদের থেকেই তো রেপের অভিযোগ উঠছে, ধরা পড়ছে। এফআইআর করতে হচ্ছে। তাই এবার তোমাদের প্রতিষ্ঠা দিবস মুলতুবি থাকুক। এটা করলে তৃণমূল সুপ্রিমোর জনপ্রিয়তাই বাড়ত। উনি ’২৬–এর ভোটেও এর ভালো প্রভাব পেতেন।”
এর পাল্টা ফের ভিসিকে কটাক্ষ করে তৃণাঙ্কুর বলেন, ‘এই ভিসি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করছেন। তাঁর বক্তব্য আমার সেই মন্তব্যকেই বৈধতা দেয়। আসলে উনি চাইছেন, যে ক’দিন চেয়ারে আছেন সেই ক’দিন এই সব করে রাজনৈতিক পুনর্বাসন পেতে।’
তবে, এসবের মধ্যে ডিএসও–র রাজ্য সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় বিশ্ববিদ্যালয়কে সমর্থন করে জানান, ‘উচ্চশিক্ষা দপ্তরের জারি করা এই নির্দেশের তীব্র বিরোধিতা করছি এবং ধিক্কার জানাচ্ছি। অতীতে পঞ্চায়েতনির্বাচন চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা গৃহীত হয়েছে। এমনকী ধর্মঘট চলাকালীনও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা গ্রহণ করতে পিছপা হয়নি। তখন তো সরকারের তরফেও কিছু বলা হয়নি।’
এরপর যেমনটা বলা হয়, ৪ঠা আগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর শান্তা দত্ত দে জানান, – “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২৮শে আগস্ট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়সূচীতেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ একজন সিন্ডিকেট সদস্যের (ওম প্রকাশমিশ্র) ভিন্নমত এবং উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধির আপত্তি ছাড়া, বাকি সকল সদস্য পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন না করার আমাদের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।“
এছাড়াও জানানো হয়, – “যে একটা দলের জন্য পরীক্ষার দিন পেছোলে, অন্যদেরকেও একই সুবিধা দিতে হবে। তা কখনোই কাম্যনয়”
তবে, এরপর ছোটখাটো চাপানউতোরের মাঝেই পরীক্ষার দিন অপরিবর্তিত রাখা হয়।
এরপর ২৪শে আগস্ট, পরীক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের দিন স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা মুলতুবি ঘোষণা করে বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর ২৭শে আগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক অভিরুপ চক্রবর্তী। যিনি খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এত বড় বেহায়া, এত বড় বেহায়া আমি জীবনে দেখিনি। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেবো। ২৮শে আগস্ট আমি ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। উনি আবার নিজে বলছেন, কেউ আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। আমি বলছি শান্তা দেবী বেশি কথা বলবেন না। আমাদেরকে যদি ঘেউ ঘেউ বলেন, আপনি রাজ্যপালের কাছে কতবার মিউ মিউ করেছেন সেটা আমরা তুলে ধরবো।‘
এরপর ওইদিন রাতে হঠাৎ করেই পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২৮শে আগস্ট বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ১১টা থেকে স্নাতকোত্তরের বাংলার টার্ম পেপারের মৌখিক পরীক্ষা ও কিমিউনিটি এনজেগমেন্টের মৌখিক পরীক্ষা ছিল। ছাত্রছাত্রীদের আর্জি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা স্থগিত করেছে।
২৮শে আগস্ট অবশেষে নোটিশ মতোই পরীক্ষা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরীক্ষা হওয়ার পর শান্তা দেবীজানান, মুখ্যমন্ত্রীর নাম করেও তাঁকে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি পরীক্ষা পেছাননি। তিনি এই ঘটনাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় হিসাবে অভিহিত করেছেন। “ তিনি এও বলেন ‘ভবিষ্যতে এমন অনুরোধ যেন না আসে” !
তৃনমূল ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে শান্তা দত্ত দে নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখার কাজ করেছেন | আপনি কি ওনাকে সমর্থন করছেন? এই প্রসঙ্গে আপনার কী মনে হয়?
গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য | Join Group |
চাকরির খবরের জন্য | Join Hood Jobs |
রাশিফলের জন্য | Join Hood Rashifal |
খেলার খবরের জন্য | Join Whatsapp |