কেবল বাংলা নয়, বাংলার বিধানসভাতেও চলে “দিদির দিদিগিরি”! গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর এমনটাই প্রমাণ করলেন তিনি। প্রথমে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে সাসপেন্ড, তারপর শঙ্কর ঘোষ, অগ্নিমিত্রা… এক এক করে পর পর ৬ জন বিরোধী নেতার সাসপেন্ড, তারপর চ্যাংদোলা করে বিজেপি বিধায়কদের ফেলে দেওয়া – একপ্রকার একনায়কতন্ত্রের সাক্ষী থাকল গোটা বাংলা!
কেবল বিজেপি বিধায়ক নয়, তৃনমূলের বিধায়কদেরও ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন তিনি। তিনি বললেন, “আমি স্পিকারকে বলব সাসপেন্ড করতে।” তবে, কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) কথাতেই চলে বাংলার বিধানসভা? সবাই কি তাঁর হাতের পুতুল? বাংলায় কি আদেও গণতন্ত্র রয়েছে?
ঠিক কী হয়েছে বিধানসভায়? আর কার জন্যই বা ধুন্ধুমার হয়ে উঠল বিধানসভা? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য জানাবো আমরা।
শুরু থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত!
দিনটা ছিল মঙ্গলবার, ২০২৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এরপর হঠাৎ করেই ব্রাত্য বসুর ওপর ভারতীয় সেনার অপমান করার অভিযোগ করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। জড়িয়ে পড়েন বাক-বিতণ্ডায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁকে সাসপেন্ড করেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর পর বৃহস্পতিবার, শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার শেষ বিশেষ অধিবেশন। বাংলাভাষীদের ভিন রাজ্যে হেনস্থা নিয়ে একটি রেজোলিউশন পাঠ করা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। কিন্তু, বিরোধীদের বাধা, আর উত্তপ্ত স্লোগানে রাগে ফেটে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী! একের পর এক বিষোদগার করতে থাকেন বিরোধী থেকে শুরু করে নিজের দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও।
প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রীর রেজোলিউশন পড়তে বাঁধা দেন BJP-র চিফ হুইপ শঙ্কর ঘোষ। তিনি স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেন, “কেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে পুরো অধিবেশনের জন্য বরখাস্ত করা হল?” স্পিকার এর উত্তর দিতে প্রত্যাখ্যান করলে স্লোগান দিতে শুরু করেন BJP বিধায়করা এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে বার বার ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করেন।
এরপর একসময় বিরক্ত হয়ে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ওরা আমার বক্তৃতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে… যখন BJP-র বিধায়করা কথা বলেন, তখন তোমাদেরও তাদের বক্তৃতায় ব্যাঘাত ঘটানো উচিত।”
এরপরেই বেঁধে যায় প্রথম ঝামেলা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী বিজেপি বিধায়কদের মধ্যে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে ‘চোর-চোর’ স্লোগানের লড়াই।
পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে, স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ করেই সাসপেন্ড করেন BJP-র চিফ হুইপ শঙ্কর ঘোষকে। স্পিকারের আদেশ অমান্য করে তাঁকে ঘিরে ধরেন BJP-র অন্যান্য বিধায়করা। ফলে স্পিকার, মার্শালদের ডেকে শঙ্কর ঘোষকে শারীরিকভাবে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর বিজেপি বিধায়ককে চ্যাংদোলা করে বের করতে থাকে মার্শালরা। যার ফলে বিজেপি বিধায়কদের সাথে কিছুটা ধাক্কাধাক্কি হয় মার্শালদের। ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়ে হঠাৎ করেই বিধানসভা কক্ষের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন শঙ্কর ঘোষ, ফলে তড়িঘড়ি বিধানসভা প্রাঙ্গণেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে শুরু হয় তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা। এরপর তিনি কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু এর মধ্যে উত্তেজনা কমেনি একচুলও।
এরপর ফের ভাষণ শুরু করলে আবার বাধা পেতে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে এক সময়ে রেগে গিয়ে সরাসরি আক্রমণ করতে থাকেন BJP-কে।
বলতে থাকেন, ‘এরা গদি চোর, ভোট চোর, বাংলা বিরোধী। বিজেপি দেশের লজ্জা। মোদী চোর। অমিত শাহ চোর। বিজেপিকে শূন্য করে দেবে বাংলার জনতা।’
তিনি আরও যোগ করেন –‘বিজেপি হচ্ছে দালালদের দল। স্বাধীনতার সময় এদের জন্মই হয়নি, তবুও ইংরেজদের দালালি করেছিল।’ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা-গান দিয়ে, স্লোগান তুলে, বিজেপিকে বাংলার শত্রু বলে দাগিয়ে দেন মমতা। (Show Video)
কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আবার বলতে থাকেন, “মোদী চোর আপনাদের মুখে বলা শোভা পায় না। আমরা তাঁকে প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে সম্মান দিই। তাই আমরা মোদী চোর বলি না।“
একনায়কতান্ত্রিক হুঙ্কার!
এরপর শঙ্কর ঘোষের প্রশ্ন পুনরায় স্পিকারের দিকে ছুঁড়ে দেন, BJP নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল। জিজ্ঞাসা করেন, “কেন সাসপেন্ড করা হল বিরোধী দলনেতাকে? ফলত, এবার অগ্নিমিত্রা পালকে সাসপেণ্ড করেন স্পিকার। যার ফলে, ফের তৃণমূলবিরোধী স্লোগান তুলতে থাকেন বিজেপি বিধায়করা। পাল্লা দিয়ে চিৎকার শুরু করেন তৃণমূল বিধায়কেরাও। দু’-পক্ষকে বসার অনুরোধ জানান স্পিকার।
বিজেপির বিরোধিতায় তৃণমূল বিধায়কেরা ওয়েলে নেমে আসায় মুখ্যমন্ত্রী নিজের আসন ছেড়ে তাঁদের শান্ত হতে বলেন। এমনকি নিজের দলের বিধায়কদের ধমক দিয়ে বলেন, “স্পিকার যখন দাঁড়িয়েছেন, আপনারা বসুন।“ কিন্তু, অনেকেই সেই কথা অমান্য করলে, সবাইকে সাসপেন্ড করে দেওয়ার হুমকি দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “যারা হাউস চালাতে বাঁধা দিচ্ছেন, ওয়েলে নেমে আসছেন, আমি স্পিকারকে বলব সাসপেন্ড করতে।“ তৃণমূলের বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে আসনে বসতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর হুমায়ুন কবীর ও নির্মল ঘোষ কথা না শুনলে তাদের ধমক দিয়ে বলেন, “আপনারা কি বসবেন? বেশি পাকা? যেখানে আমি বলছি বসতে, বসো। আমি একাই একশো। আমার কারোর সাপোর্ট চাই না। এটা মানুষের গলা মাথায় রেখো।“ এইভাবেই নিজের দলের কর্মীদের ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিরোধীদের উদ্দেশ্যে ব্যাক্তিগত আক্রমণ!
এরপর বিজেপি বিধায়কদের উদ্দেশ্যে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বিজেপি বিধায়ক মিহির গোস্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার লজ্জা করে না? আপনি চারবার দল বদল করেছেন। একবার কংগ্রেস, একবার সমাজবাদী পার্টি, একবার তৃণমূল আর এখন বিজেপি! চারটে পার্টি বদল করে জ্ঞান দিতে এসো না।” এরপর তাপস রায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘তুমি তৃণমূল করতে তাপস, তোমার লজ্জা থাকা উচিত। বনিবনা হয়নি অনেক টাকার ব্যাপার ছিল।“ এছাড়াও তিনি অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যাঁরা স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁরাও তৃণমূল করতেন। ইডি সিবিআই থেকে বাঁচতে, টাকা বাঁচাতে বিজেপিতে গিয়েছেন।‘
বাড়তে থাকে সাসপেনশনের তালিকা
BJP-র অগ্নিমিত্রা পালের পর, মিহির গোস্বামী, অশোক দিন্দা, বঙ্কিম ঘোষকে – একে একে সাসপেন্ড করেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। মিহির গোস্বামী বেরোতে অস্বীকার করলে, তাঁকে মার্শালরা পাঁজকোলা করে বাইরে বার করে দেয়। এদিন একনায়কতান্ত্রিক ভঙ্গিতে এভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হল বিরোধীদের বিরোধিতা।
জাতীয় ইস্যু নিয়ে মমতার বার্ত
এদিন বিধানসভায় বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক বার্তা দিতে ভোলেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ট্যারিফ প্রসঙ্গে মোদীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘আজ রাশিয়া, চিন, আমেরিকা , ইজ়রায়েলের পায়ে পড়েছেন। দেশটার সম্মান নষ্ট করছেন।’’
এরপর GST 2.0 প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিমা থেকে জিএসটি বাদ দেওয়ার কথা আমি বলেছিলাম। তা করতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র।’’
এরপর CAA, NRC প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘২০২৪ সালের মধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের রেশন, নাগরিকত্ব, সাংবিধানিক অধিকার দেবেন তো?’’
শেষমেশ ওয়াকআউট করেন বিজেপি বিধায়কেরা।
অর্থাৎ রাজনীতির ইতিহাসে কতটা বিশেষ হয়ে থাকবে ৪ঠা সেপ্টেম্বরের এই বিশেষ অধিবেশন, সেই নিয়ে জোর তর্ক চললেও, মমতার বার্তা কিন্তু পরিষ্কার – শুধু রাজ্য নয়, দেশজুড়ে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি নিজেই। বিরোধী শিবিরের তীব্র আক্রমণ হোক, কিংবা দলের ভেতরে তাঁর অমান্যতা – আপস করবেন না তিনি। একাই লড়বেন নিজের লড়াই।
এটা কি একনায়কতন্ত্রের চিত্র? নাকি রাজনৈতিক কৌশল – দলের ভেতর-বাইরে সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা?
আপনারা কী মনে করেন? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না মতামত।