হঠাৎ করেই ব্যান করে দেওয়া হল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম সহ ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া! যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সম্পূর্ণ নেপালবাসীর। প্রতিবাদে রাস্তায় নামল গোটা দেশের তরুণ প্রজন্ম। ইস্তফা দিতে হল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি খোদ রাষ্ট্রপতিকেও। মার খেতে হল দেশের উপমন্ত্রী থেকে বিদেশমন্ত্রীকে। তারপরেও আগুন জ্বলল সারা দেশে, পুড়ল রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, এমনকি পার্লামেন্টও।
গত এক সপ্তাহে ঠিক কী এমন হল যার জন্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল (Nepal Burning Reason)? সারা দেশ জুড়ে চলল লুট ও হিংসা। কারা রয়েছে এর পিছনে? কেন সবাই দ্বিতীয় বাংলাদেশ বলছে নেপালকে? দাবী মেনে নেওয়ার পরেও কেন চলল অরাজকতা? প্রতিবাদ নাকি কোনও বিদেশি ষড়যন্ত্র – কেন পতন হল নেপাল সরকারের?
আজ এক এক করে সেই সমস্ত তথ্য ডিকোড করবে India Hood!
ঘটনার সূত্রপাতঃ
ঘটনাটা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস। নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের নেতৃত্বে নেপাল সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে, যা সোশ্যাল মিডিয়া অপারেশন ডিরেক্টিভ, 2080 নামে পরিচিত। সেই ডিরেক্টিভে ১৫টি নির্দেশনা দেওয়া ছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, এবং সাইবার অপরাধ (যেমন: সাইবার বুলিং, গুজব, ডিজিটাল অপরাধ) প্রতিরোধ করা। সেই ১৫টি নির্দেশনার ৩ নম্বর ক্লজ অনুযায়ী, যদি কোনো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নেপালে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে চায়, তাহলে সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে আবশ্যিকভাবে নেপালের যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার অফিস বা সেই সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রিভেন্স অফিসার নিয়োগ করতে হবে, এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
এরপর ২০২৪ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী হন খড়গ প্রসাদ শর্মা ওলি ওরফে কে.পি শর্মা ওলি। ওলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক শুনানি হয়, এবং শেষ শুনানিতে দেশের সুপ্রিম কোর্ট ওই নীতি লাগু করার অনুমোদন দেয়।
এর পর ২০২৫ সালের ২৫শে আগস্ট, ক্যাবিনেট পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়ার রেজিস্ট্রেশন আবশ্যক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর ২৭শে আগস্ট মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে একটি সরকারি নোটিশ জারি করা হয়। সেই নোটিশ অনুযায়ী, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, এবং একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। ডেডলাইন শেষ হলে নিয়ম অমান্যকারী প্ল্যাটফর্মগুলির বিরুদ্ধে ব্লকিং প্রক্রিয়া চালানো হবে, এবং ইন্টারনেট/আইএসপি পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
৭ দিন পর অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর সেই ডেডলাইন শেষ হয়। দেখা যায় কোনও সোশ্যাল মিডিয়াই সরকারের নির্দেশ মানেনি। ফলত মন্ত্রকের তরফ থেকে নেপালের টেলিকম দফতরকে ২৬টি প্ল্যাটফর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়, এবং এই নির্দেশিকা ৪ তারিখ মধ্যরাত থেকে লাগু করতে বলা হয়।
এই ২৬টি অ্যাপের মধ্যে রয়েছে, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, এক্স (পূর্বে টুইটার হিসাবে পরিচিত), লিঙ্কডইন, স্ন্যাপচ্যাট, রেডডিট, ডিসকর্ড, পিন্টারেস্ট, সিগন্যাল, থ্রেড, উইচ্যাট, কোরা, টাম্বলার, ক্লাবহাউস, মাস্টোডন, রাম্বল, মিউই, ভিকন্টাক্ট, লাইন, ইমো, জালো, সোল, হামরো প্যাট্রো।
কিন্তু পাশাপাশি বেশ কিছু অ্যাপ যেমন, চিনা অ্যাপ টিকটক, ভাইবার, উইটক, এবং পপো-র মতো বিভিন্ন অ্যাপ সরকারের সমস্ত নিয়ম মেনে নেওয়ায় এগুলিকে চালু রাখা হয়।
এরপর META, উইচ্যাট-এর মতো সংস্থা টেলিফোনের মাধ্যমে সরকারি নিয়ম সম্পর্কে অনুসন্ধান করলেও, মেলের মাধ্যমে নেপাল সরকারের নিয়মের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য কোনও ধরনের আবেদন করেনি। শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া X-এর তরফ থেকে সরকারের কাছে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। এবং নেপালি অ্যাপ হামরো প্যাট্রো রেজিস্ট্রেশন জন্য এগিয়ে এসেছে।
জনতার বিক্ষোভের কারণঃ
এসবের মাঝেই হঠাৎ করে নেপালের ক্ষমতাসীন বিভিন্ন ব্যাক্তিদের সন্তানদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দু-তিনটি হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিংয়ে আসতে থাকে সারা নেপাল জুড়ে। যার মধ্যে #NepoKid, #NepoBaby সবথেকে বেশি ট্রেন্ডিংয়ে উঠে আসে। মূলত নেপালের নেতা, মন্ত্রী, রাজ পরিবারের স্ত্রী, সন্তানদের বিদেশ যাত্রা, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনের ছবি শেয়ার হতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান হলেও, VPN ব্যবহার করে, এবং চালু থাকা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে TikTok-এ ভাইরাল হতে থাকে এই সমস্ত ছবি এবং হ্যাশট্যাগ।
এমনকি অনেকের দাবী নেপালের জনগণের মধ্যে এই ধরনের ছবির প্রচার আটকাতেই সরকার সোশ্যাল মিডিয়া বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে। নেপাল সরকার এই ব্যানকে যতই জাতীয় সুরক্ষার নাম দিক, এটি আসলে নেতা সুরক্ষা।
৫ই সেপ্টেম্বরের পর থেকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকে ক্ষোভ। নেপালি আমজনতা থেকে শুরু করে ইনফ্লুয়েন্সার, সংবাদমাধ্যম, বিরোধী দল সবাই শুরু করে বিরোধিতা। কারোর বক্তব্য, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের বাইরে যাওয়া পরিবার-পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেপালবাসী। কারণ রিপোর্ট অনুযায়ী নেপালের প্রায় ৭০ লক্ষেরও বেশি তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরিসূত্রে দেশের বাইরে বসবাস করেন। আবার অনেকের বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হলে বেকার হয়ে যাবে বহু নাগরিক। কারণ বর্তমানে ইনফ্লুয়েন্সার হোক, বা পর্যটন বা অন্যান্য ব্যবসার অধিকাংশই টিকে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগের মাধ্যমে। আবার অনেকেই এই পদক্ষেপকে স্বাধীনতা খর্ব, কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের নাম দিতে থাকে।
এরপর ৬ই সেপ্টেম্বর, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল নিজেরই জারি করা নিয়মের বিরোধিতা করতে শুরু করে। বর্তমানে দেশের প্রধান বিরোধী দল সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র)-এর চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত কমল দহল, সরকারকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।
GEN Z NEPAL-এর জন্মঃ
এরপর নেপালের এই প্রতিবাদে উঠে আসে হামি নেপাল নামে একটি সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ৩৬ বছর বয়সী সুদান গুরুং। এর সহ প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক ছিলেন উজেন রাজ ভাণ্ডারি। যারা এতদিন জনপ্রিয় ছিলেন সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্য, এবার তারাই তুললেন প্রতিবাদের দাবি।
সুদান গুরুং নিজের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করে, ৮ই সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রতিবাদের ডাক দেন। এরপর ওই NGO-র তরফ থেকে চালু থাকা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্যবহার করে বিশেষ করে Discord, TikTok এবং Instagram-এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে ব্যানার, পোস্টার সরবরাহ করতে থাকে। VPN-এর মাধ্যমে এবং লোক মুখে এই কথা ধীরে ধীরে চাউর হতে থাকে সারা নেপালে। পাশাপাশি এই আন্দোলনে কোনও ধরনের রাজনৈতিক দল এবং যুব নেতাদের অংশগ্রহণ করতে বারণ করা হয়। কারণ প্রথম থেকেই এই প্রতিবাদের উদ্দেশ্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান নয়, ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে।
Gen Z Nepal নামের এই প্রতিবাদের গন্তব্য ঠিক করা হয়, কাঠমান্ডুর কোটেশ্বর থেকে নিউ বানেশ্বরের এভারেস্ট হোটেল পর্যন্ত, যা পার্লামেন্ট থেকে ১০-১২ মিনিট দূরে। তবে, জেলা প্রশাসন এই আন্দোলনের অনুমতি কোটেশ্বরের পরিবর্তে মেইটিঘর থেকে মঞ্জুর করে।
নেপালের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায়!
এরপর আসে সেই দিন। অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর। যা নেপালের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক এবং কালো দিন হিসাবে উঠে আসবে তা কেউ ভাবতেই পারেনি।
সকাল থেকেই কাঠমান্ডু, পোখরা, চিতওয়ান সহ বিভিন্ন স্থানে তিলে তিলে জড়ো হতে থাকে তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা। চমকে দেওয়ার মতো ঘটনায় দেখা যায় স্কুলের পোশাক পরিহিত কচি-কাচাদেরও। সময় মেনে সকাল ৯টা থেকে তরুণরা মেইটিঘর পার্কে জড়ো হতে শুরু করে। তারা মিছিল করে সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পরিকল্পিত জায়গা নিউ-বানেশ্বরের এভারেস্ট হোটেলের কাছে পৌঁছে যায়। সেখানে বেলা বাড়ার সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে জনসমাগম। শুরু হতে থাকে ধাক্কাধাক্কি, ফলে ব্যারিকেড নিয়ে টানাপড়েন চলতে থাকে পুলিশ ও জনতার মধ্যে। যার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎক্ষণাৎ জলকামান, রাবার বুলেট ও টিয়ার-গ্যাস ব্যবহার শুরু করে পুলিশ। ভিড় থেকে উড়ে আসতে থাকে বিভিন্ন বস্তু।
পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে জেনে পার্লামেন্টে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত সেনা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে পুলিশের তরফ থেকে চালানো হয় গুলি। কারোর মাথা, কারোর বুক ভেদ করেও মিছিল থামাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। এরপর একাধিক মানুষ প্রবেশ করে পার্লামেন্টের ভিতরে, চালায় ভাঙচুর। নিরাপত্তা বাহিনী আরও কঠোর হয়ে গুলি বর্ষণ করতে থাকে নির্দয়ভাবে, যার ফলে অন্তত ২১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় প্রায় ৪০০ জন, যার মধ্যে ছিল একাধিক পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মী। এরপর, উঠতে থাকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবী। ইট বৃষ্টি করা হয় প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক বাড়িতে। যার পর সন্ধ্যার দিকে ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে ইস্তফা দেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। বিদ্রোহ দমন করতে কার্ফু জারি করে প্রশাসন। বিদ্রোহ বাড়তে থাকলে অবশেষে বাধ্য হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর থেকে ব্যান তুলে নেয় নেপাল সরকার। প্রধানমন্ত্রী এরপর জানান, “আমরা ছাত্রদের বিরোধী নই। তাদের দাবী শুনবো। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়ায়, তাদের মেরেছে পুলিশ।“
যুবকদের মৃত্যু এবং সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব দেখে, এবার ৯ই সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই নেপালের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-যুবকদের আন্দোলন। স্লোগান উঠতে থাকে, ‘কেপি চোর, দেশ ছোড়’। এমনকি ক্ষিপ্র জনতা নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেলের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাশাপাশি নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল এবং ঝালানাথ খানালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। ঘটনায় পুড়ে মৃত্যু হয় ঝালানাথ খানালের স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী চিত্রকরের। দুপুরের দিকে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পৌডেলকে রাস্তায় তাড়া করে পেটায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এরপর বিক্ষোভকারীদের হাতে মার খায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং তাঁর স্ত্রী বিদেশমন্ত্রী আরজু রানা দেউবা। নেপালের বিভিন্ন প্রান্তে নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুন ধরানো হয় নেপালের পার্লামেন্টেও। বাদ যায় না নেপালের সিংহ দরবারও।
এখানেই শেষ হয়নি জনতার মারমুখী রূপ। এরপ নেপালের ধনগড়ি, পোখরা, কাঠমান্ডুর নাখু জেলে হানা দেয় বিক্ষোভকারীরা, লাগিয়ে দেয় আগুন। সেই সুযোগে জেল ভেঙে পালায় প্রায় ২০০০-এর বেশি বন্দি। জেল থেকে পালিয়ে যায় বিরোধী দলনেতা রবি লামিছানেও। পুলিশ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পলাতকদের ওপর গুলি চালালে ৫ জেল পলাতকের মৃত্যু হয়। নেপালের কোটেশ্বরে তিন পুলিশ কর্মীকে পিটিয়ে খুন করে বিক্ষোভকারীরা।
এরপর বিকালের দিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন কেপি শর্মা ওলি। ইস্তফা গ্রহণ করে, দেশের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েল সবাইকে শান্ত হয়ে আলোচনায় যোগ দিতে বলেন। কিন্তু, তাতেও শান্ত হয়নি জনতা। ফলে বাধ্য হয়ে ইস্তফা দেন রাষ্ট্রপতি নিজেও। এরপর সুপ্রিম কোর্ট, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, কাঠমান্ডু জেলা আদালত এবং পাটান হাইকোর্ট ভাঙচুর করা হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুন ধরানো হয় একাধিক সরকারি অফিসে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং স্কুলগুলিতে হামলা চালানো হয়। নেপালের কান্তিপুর মিডিয়া হাউসে ভাঙচুর চালানো হয়। যার ফলে বন্ধ রয়েছে এই সংস্থার সমস্ত টেলিভিশন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি। মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান কৈলাস সিরোহিয়ার ব্যক্তিগত বাসভবনেও আক্রমণ চালানো হয়। তিনকুনে অবস্থিত অন্নপূর্ণা মিডিয়া নেটওয়ার্কের সদর দপ্তরও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল এবং সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র)-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এক ডজনেরও বেশি রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত বাসভবন ভাঙচুর করা হয়। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে, ৯ই সেপ্টেম্বর রাতেই রাজধানী কাঠমান্ডুর নিয়ন্ত্রণ নেয় নেপালের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে এবং কারফিউ জারি করা হয়। নেপালের সেনা প্রধান অশোক রাজ সিগদেলও বিক্ষোভকারীদের আলাপ আলোচনার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি দেশে লুটপাট চালালে, ভাঙচুর করলে কড়া পদক্ষেপের বার্তাও দেন তিনি। এরপর আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে দেশের দায়ভার তুলে নেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয় দেশের ৩৫ বছরের মেয়র বলেন্দ্র শাহকে। কিন্তু, তিনি সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। মঙ্গলবারের হিংসায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৯। আহতের সংখ্যাও অনেক।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারপরেও হিংসা থামেনি নেপালে। সেনার তরফ থেকে প্রতিবাদকারীদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বলা হলেও, দাবী মেনে নেওয়া হলেও, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ব্যান উঠলেও, পদত্যাগ হলেও, জ্বলছে দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন। এরপর ১০ই সেপ্টেম্বর সকালে হামলা চালানো হয় দেশের পশুপতিনাথ মন্দিরে। আপাত পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ওলি সহ একাধিক নেতা দেশ ছাড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ও ভিডিও ছাড়া হয়েছে। তবে, দেশের তরফ থেকে এই ধরনের কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
এরপর ১০ তারিখ সন্ধ্যায় প্রায় ৫০০০ GEN Z ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি-কে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার আর্জি জানিয়েছে।
সেই আবেদন অনুযায়ী, ১২ই সেপ্টেম্বর দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেছেন সুশীলা কার্কি। এরপর তিনি ক্ষমতায় বসেই আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের ৫ই মার্চ সারা দেশে নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করেছেন। পাশাপাশি তিনি নেপালের Gen-Z আন্দোলনে মৃত ৭২ জনের পরিবারকে ১০ লক্ষ নেপালি রুপি অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁদেরকে শহিদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এই সবের মধ্যেও বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে, যা লুকিয়ে রাখা হয়েছে আমজনতার থেকে –
১। ২০১৬ সালে নেপালের ৩১টি মহিলা সংগঠন সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি অভিযান করে। অর্থাৎ, যে দেশে আগেও সোশ্যাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে দেশের নাগরিক অভিযান করেছে, সেই নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে হঠাৎ সবাই রেগে গেল কেন?
২। নেপাল পুলিশ ও প্রশাসনের স্বৈরাচারী মনোভাবের একাধিক ঘটনা গত এক সপ্তাহ ধরে দেখা গিয়েছে টেলিভিশনের পর্দায়, সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়, খবরের কাগজে। কিন্তু, একাধিক মিডিয়া এবং ইউটিউবাররা নেপালের এই ঘটনায় প্রশাসনের তরফ থেকে স্যুট অ্যাট সাইটের অর্ডার দেওয়ার কথা উল্লেখ করলেও, অফিসিয়াল এমন কোনও তথ্য নেই।
৩। এই আন্দোলনের অন্যতম মূল উদ্যোক্তা উজেন রাজ ভাণ্ডারী জানিয়েছেন, “আমাদের আন্দোলনে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি দল ছিল, এবং পরিকল্পনা ছিল কেবল এভারেস্ট হোটেল পর্যন্ত মিছিল করা। যারা ওই স্থান পেরিয়ে গেছে তাদের আমরা জানি না। আমরা ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে বলেছি। যারা এখনও যাননি, অনুগ্রহ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে বেরিয়ে যান। বেশ কয়েকটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনতাকে উসকানি দিচ্ছে। আমাদের দিনটি ইতিমধ্যেই সফল হয়েছে।” এই একই কথা প্রধানমন্ত্রী ওলিও ঘটনার দিন অর্থাৎ ৮ই সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন।
৪। একাধিক পর্যটকদের বা কর্মসূত্রে নেপালে থাকা লোকেদের ওপরেও হামলা করা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের তরফ থেকে।
৫। চোরেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরাই চোর হয়ে গেল প্রতিবাদকারীরা! যার পরে লুট হল একাধিক শপিংমল! এখানেও ধরে নেওয়া গেল জামা-কাপড় লোকের প্রয়োজনে লাগে, কিন্তু ভাবুন পুলিশ স্টেশন লুট করে বের করে নেওয়া হল পছন্দ মতো আগ্নেয়াস্ত্র! সেটি কোন কাজে লাগবে?
আন্দোলনের পিছনে লুকিয়ে থাকা আসল কারণ!
এটা নিয়ে কমবেশি প্রায় সকলেই জানেন। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নেপালের এই হিংসার মূল কারণ নয়, এর পিছনে রয়েছে উচ্চ বেকারত্ব, সীমিত কর্মসংস্থান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। জানলে অবাক হবেন, নেপালে কাজের অবস্থা এতটাই খারাপ যে টাকার জন্য রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে পর্যন্ত লড়তে যাচ্ছে নেপালি যুবকরা। ৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ নেপালের সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ওলির সম্পত্তির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা! যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩ কোটি! শুধু তাই নয়, নেপালের মাথায় ঋণ হয়েছে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকার।
হামি নেপাল সংগঠনের চেয়ারপার্সন সুদান গুরুংয়ের মতে, “এই প্রতিবাদ সরকারি পদক্ষেপ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কর্মসংস্থানের অভাব, জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থাপনা নিয়েও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। ফলে নেপালি তরুণদের অনেকেই দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নেপালের একাধিক প্রধামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরকারি জমি নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই সব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষোভ জমছিল।“
এরপর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করা হলে এই ক্ষোভ ফেটে পড়ে।
ওলির পদত্যাগের পর Gen Z Nepal-এর দাবি,
১। বর্তমান রিপ্রেসেন্টেটিভ কাউন্সিল অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যা জনসাধারণের আস্থা হারিয়েছে।
২। নাগরিক, বিশেষজ্ঞ এবং তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংবিধান সংশোধন বা সম্পূর্ণ পুনরায় লিখতে হবে।
৩। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের পরে নতুন নির্বাচন পরিচালনা করা, এবং সেগুলি যাতে স্বাধীন, সুষ্ঠু এবং সরাসরি জনসাধারণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হয় সেই বিষয়ে নিশ্চিত করা।
৪। সরাসরি নির্বাচিত নির্বাহী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
৫। গত তিন দশকে লুট হওয়া সম্পদের তদন্ত, অবৈধ সম্পত্তি জাতীয়করণের পরিকল্পনা করা।
৬। পাঁচটি মৌলিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত সংস্কার এবং পুনর্গঠন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ।
১৭ বছরে নেপালে পরিবর্তন করা হয়েছে ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী?
২০০৮ সালের মে মাসে নেপালের সংবিধান সংশোধন করে দেশের রাজতন্ত্র ভেঙে নেপালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ছিলেন দেশের শেষ রাজা। জানলে অবাক হবেন। এর পর শেষ ১৭ বছরে ওলিকে নিয়ে ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, এবং হয় রাজনৈতিক রোষে, কিংবা দলের রোষে তাদের প্রত্যেককে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
কিন্তু ২০২৫ সালের মার্চ মাসে সেই নেপালের জনগণই পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ডাক দেয়।
জানলে অবাক হবেন, বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্র সিরিয়া, চিন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, মায়ানমারের মতো দেশেও ব্যান করা আছে একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু, কোনও দেশেই নেপালের মতো পরিণতি হয়নি। আপনার কি মনে হয় নেপালের এই অবস্থা সম্পর্কে? জানাতে ভুলবেন না কমেন্ট বক্সে।