বিশ্বকর্মা পুজোয় চোখে জল নিয়ে গেটে প্রণাম কর্মীদের! ডানলপ কারখানা আজ যেন শ্মশান

Published on:

Dunlop Factory

সৌভিক মুখার্জী, কলকাতা: একটা সময় রাজ্যের সবথেকে গর্বের জায়গা ছিল ডানলপ। টায়ার মানেই নাম উঠত ডানলপের, সাহাগঞ্জ মানেই কর্মচঞ্চল শিল্পাঞ্চল (Dunlop Factory)। পাশপাশি বিশ্বকর্মা পুজো আসলেই হাজারও আলো, উৎসব, আনন্দে মুখরিত হতো গোটা এলাকা। একেবারে দুর্গাপুজোর মতো জাঁকজমক করে পুজোর আয়োজন করা হতো। তবে আজ সেখানে শুধুমাত্র নীরবতা, একেবারে শ্মশান হয়ে গিয়েছে জায়গাটা। বন্ধ গেটের সামনেই প্রাক্তন শ্রমিকদের ভিড় আর দূর থেকেই প্রণাম করে চলে যাচ্ছেন তাঁরা। বুকের ভেতরে শুধু হাহাকার আর চোখে জল! কিন্তু কী এমন হল এই ডানলপ কারখানার? সমস্তটা তুলে ধরব আজকের প্রতিবেদনে।

ইতিহাসের শুরুটা স্কটল্যান্ড থেকে

প্রসঙ্গত, ১৮৮৭ সালে স্কটল্যান্ড পশু চিকিৎসক জন বয়েড ডানলপ এই আধুনিক রাবারের টায়ার তৈরি করেছিলেন। ট্রাইসাইকেল থেকে শুরু করে বাইসাইকেল, তারপর একে একে গোটা পৃথিবী জুড়েই এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালে তাঁর কোম্পানি ডানলপ নিউম্যাটিক টায়ার কোং লিমিটেড আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে জার্মানি, ফ্রান্স, এমনকি জাপান পর্যন্ত এই ডানলপের কারবার ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলায় ডানলপের পথচলা

এরপর ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ আমলে বাংলার হুগলির সাহাগঞ্জে ভারতের প্রথম টায়ার কারখানা তৈরি হয়। আর তা থেকেই রাতারাতি গোটা এলাকার চেহারা বদলে যায়। শ্রমিকদের পরিচয় হয় “ডানলপ বাবু” নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কারখানাতেই এরোপ্লেন, ফাইটার প্লেনের চাকা তৈরি হতো, যা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায় বলা চলে।

এদিকে সাহাগঞ্জের সাফল্যের জোয়ার ভেসে যায় নদীর ওপারেও। বরাহনগরের ডানলপ মোড়ে আজও সেই নামের ছাপ লেগে রয়েছে। তখনকার দিনে রেল ব্রিজে বিজ্ঞাপন রঙ করে বসানো হতো, যা থেকে এলাকার নাম হয়ে যায় ডানলপ মোড়। আর আজও সেই নাম বেঁচে রয়েছে। তবে কোম্পানিটির জৌলুস আর নেই, এখন পরিণত হয়েছে শ্মশানে!

বিপুল শ্রমিকের ভরসা ছিল এই কারখানা

ইতিহাস বলছে, ডানলপের হুগলি কারখানায় একসময় ১৪২০ জন কর্মী কাজ করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই কারখানায় তালা পড়ায় সবাই কর্মহীন। কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ২০০৭ সালে এই কারখানার লোডআউটের সময়তেও ৭০০ জনের বেশি কর্মী প্রভাবিত হয়েছিল। তাই বোঝাই যায় যে, সাহাগঞ্জের এই ডানলপ কারখানাটি দেশ তথা এশিয়ার প্রথম টায়ার উৎপাদনকারী কারখানাগুলির মধ্যে একটি ছিল এবং প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের জায়গা ছিল।

এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ডানলপের ফ্যাক্টরি

একসময় বিশ্বকর্মা পূজা মানেই ডানলপের সেরা উৎসব হিসেবে পরিচিত ছিল। একেবারে দুর্গাপূজার মতো করে আয়োজিত হত। মেলা বসতো, নাটক-থিয়েটার হতো। এমনকি সাধারণ মানুষ কারখানার ভেতরে টায়ার বানানোর কাজও দেখতে পেতেন। তবে সেসব এখন সব অতীত। ২০১১ সালে ডানলপে সাসপেনশনের নোটিশ ঝোলানো হয়। এরপর থেকে কারখানার ব্যস্ততা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। শ্রমিকরা পিএফ এবং গ্র্যাচুইটির দাবিতে পথে নামেন। সরবরাহকারীরা হাইকোর্টে মামলাও করতে বাধ্য হন। তারপর ২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশে কোম্পানি লিকুইডেশনে চলে যায়।

কেন বন্ধ হল এই ডানলপ কারখানা?

আসলে ডানলপ কারখানা বন্ধ হওয়ার মূল কারণ শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সাথে ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ আলোচনা ব্যর্থ হওয়া, পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কিছু সমস্যা, কর্মচারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং আর্থিক অব্যবস্থাপনা। ২০০৮ সালের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সাহাগঞ্জের কারখানার কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে শ্রম সমস্যায় এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বর্তমান দৃশ্য

এখন এই কারখানার ভেতরে শ্মশানের মতোই দৃশ্য। কারণ মরচে পড়া লোহার গায়ে আজও শুধুমাত্র “ডানলপ” লেখা রয়েছে। আশেপাশে জঙ্গল ঢাকা, আর বিশ্বকর্মা পূজার দিন প্রাক্তন শ্রমিকরা কারখানার গেটের সামনে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করেন। আবার কেউ কেউ চোখে জল নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আগে এই দিনে কি যে আনন্দ হত! পুজোর সময় মানুষের ভিড় এখানে ঢেকে যেত, আর আজ সব কিছু ইতিহাস!

আরও পড়ুনঃ ২০ দিন পর উদ্ধার বীরভূমের নিখোঁজ ছাত্রীর টুকরো টুকরো দেহ! গ্রেফতার অভিযুক্ত শিক্ষক

যদিও ২০২১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর ডানলপ অধিগ্রহণের প্রস্তাব আনা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। তবে যে কজন শ্রমিক এখনও পর্যন্ত পে রোলে রয়েছেন, তাঁদের ভাতা মেলে, কিন্তু তা দিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটেনা বললেই চলে। তবুও প্রত্যেক বিশ্বকর্মা পুজোয় তাদের একটাই আশা যে, আবারও এই কারখানার গেট খুলে যাক এবং সাহাগঞ্জের এই ডানলপ কারখানা ঝলমলে হয়ে ফিরুক…!

গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্যJoin Group
চাকরির খবরের জন্যJoin Hood Jobs
রাশিফলের জন্যJoin Hood Rashifal
খেলার খবরের জন্যJoin Whatsapp
সঙ্গে থাকুন ➥