India Hood Decode: সোনম ওয়াংচুক হিরো নাকি ভিলেন? পর্দা ফাঁস

Published:

Sonam Wangchuk
Follow

নেপালের আগুন এবার ছড়িয়ে পড়ল ভারতের লাদাখেও! শুরু হল পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ। ঠিক যেন শুরু হয়েছে ভারতের Gen Z প্রতিবাদ, সরকার ফেলে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র!

“লাদাখকে আলাদা রাজ্য করতে হবে”, “লাদাখবাসীকে দিতে হবে সম্পূর্ণ ক্ষমতা” – এমনই বেশ কিছু দাবি নিয়ে বহুদিন ধরেই সোনম ওয়াংচুকের (Sonam Wangchuk) নেতৃত্বে চলছিল শান্তিপূর্ণ অনশন প্রতিবাদ। কিন্তু, ২৪শে সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লাদাখ। সকাল থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। হিংসাত্মক প্রতিবাদ থামাতে মাঠে নামে পুলিশ। আর এর পরেই ঘটে বিপত্তি। পুলিশ ও জনতার মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। বিক্ষিপ্ত জনতা আগুন লাগিয়ে দেয় বিজেপির পার্টি অফিসেও। আগুন লাগানো হয় পুলিশের গাড়িতেও। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাটানো হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল, শুরু হয় লাঠিচার্জ। বিকেল ৪টে পর্যন্ত মৃত্যু হয় চার জনের, আহত হন প্রায় ৮০ জন। শেষ পর্যন্ত জারি হয় কার্ফু। উস্কানিমূলক এবং পুরানো ভিডিয়ো না ছড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

অশান্তির পরেই, নিজের অনশন ভঙ্গ করেন সোনম ওয়াংচুক। তিনি জানান,“কোনও সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করছি না।“

অন্য দিকে, সরকারের তরফ থেকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয় সোনমকেই।

এর পরেই প্রকাশ্যে আসে সোনমের NGO-তে বিদেশি ফান্ডিংয়ের তথ্য।

আর, তার পরেই ২৬শে সেপ্টেম্বর, গ্রেফতার করা হয় সোনম ওয়াংচুককে।

তবে কি, ভারতের সরকার ফেলতে শুরু হয়েছে আমেরিকার ডিপ স্টেট থিওরি? নাকি এর পিছনে রয়েছে চিনের মদত? ঠিক কী কারণে বিক্ষোভ করছে লাদাখের যুবকরা? যে সোনম ওয়াংচুক এক সময় সমর্থন করেছিলেন মোদীকে, আজ কেন তিনি সরকারের বিরুদ্ধে? আদৌ কি এই ঘটনা কোনও রাগের বহিঃপ্রকাশ? নাকি কোনও প্রি-প্ল্যানড হিংসাত্মক বিক্ষোভ? আজ আমরা তুলে ধরবো লাদাখ বিক্ষোভ সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য, এমন কিছু সত্য যা চিন্তায় ফেলবে আপনাকেও।

প্রথমেই আমরা আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবো সোনম ওয়াংচুকের সাথে।

থ্রি ইডিয়টসের ফুংসুক ওয়াংড়ু-কে মনে পড়ে? যে ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল এই চরিত্রটি, তিনি হলেন সোনম ওয়াংচুক। ১৯৬৬ সালে তাঁর জন্ম হয় লাদাখে। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই ১৯৮৮ সালে তিনি শুরু করেন ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ অর্থাৎ SECMOL নামের একটি NGO। এরপর একাধিক সরকারি উপদেষ্টা হিসাবে ও লাদাখের উন্নতির স্বার্থে বিভিন্ন কাজ করেন তিনি। ২০১৮ সালে তিনি চালুক করেন ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অলটারনেটিভস’ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা নয়, হাতেকলমে শেখানো জীবনধারণের পাঠ। তিনি লাদাখের কৃষকদের জন্য আবিষ্কার করেছেন আইস স্টুপা, যা জলের সংকট মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছি। এছাড়াও, তিনি ভারতীয় সৈন্যদের জন্য আবিষ্কার করেছেন, সোলার-চালিত তাঁবুর, যা মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠাণ্ডাতেও ১৫ ডিগ্রির পাশাপাশি তাপমাত্রা প্রদান করবে, অর্থাৎ এই তাঁবু ব্যবহার করলে ঠাণ্ডায় আরাম পাবেন সৈনিকরা।

কিন্তু, এত ভালো একজন বিজ্ঞানী, সমাজসেবী হঠাৎ করে কী করে হয়ে উঠলেন সরকারের চক্ষু শূল?

২০১৯ সালে, ৩৭০ ধারা রদ করার পর আলাদা আলাদা দুটি রাজ্য হিসাবে মর্যাদা পায় জম্মু আর কাশ্মীর। অন্যদিকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি পায় লাদাখও। আর কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তেই নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা জানিয়ে টুইট করেন সোনম ওয়াংচুক।

https://x.com/Wangchuk66/status/1158400319526596608

কিন্তু, লাদাখকে দেওয়া হয়নি কোনও নিজস্ব বিধানসভা, যথাযথ সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং আইনগত ক্ষমতা। যা নিয়ে ওই বছর থেকেই আলাদা রাজ্য সহ একাধিক দাবি তুলে “Save Ladakh” আওয়াজ তোলেন তিনি।

পাথর এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য নির্বিচারে ডিনামাইট ফাটিয়ে লাদাখের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে, এমনই অভিযোগ তোলেন সোনম। এরপর ২০২৩ সালে প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচানোর দাবিতে অনশন শুরু করেন তিনি।

এরপর ২০২৪ সালে দু-দফায় অনশন করেন তিনি। প্রথমটি লাদাখে, পরেরটি দিল্লির লাদাখ ভবনের সামনে। সেখান থেকে তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও, দমেননি সোনম।

এরপর সালটা ২০২৫। ১০ই সেপ্টেম্বর আলাদা রাজ্যের দাবিতে ফের ৩৫ দিনের অনশন শুরু করেন তিনি।

১৫ই সেপ্টেম্বর, সোনমের দুই সংস্থার বিরুদ্ধে নিয়ম ভেঙে বিদেশি অনুদান নেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠায় সিবিআই। সোনম জানায়, ‘‘আমরা বিদেশি ফান্ডের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাই না, তবে আমরা আমাদের জ্ঞান রফতানি করি এবং তার বিনিময়ে টাকা নিই। এই টাকাকেই হয়তো সিবিআই ভেবেছে বিদেশি অনুদান।’’

এরপর ২৪শে সেপ্টেম্বর সেই প্রতিবাদ হিংসাত্মক রূপ নিলে অনশন প্রত্যাহার করে নেন সোনম।

কিন্তু, ২৫শে সেপ্টেম্বর, বড় পদক্ষেপ নেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সরকারের তরফে জানানো হয়, “সোনমের সংস্থা SECMOL, ভারতের আইন লঙ্ঘন করে, ২০২১-২২ সালে ৩ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা নিয়েছিল। তাই তাদের এই সংক্রান্ত লাইসেন্স বাতিল করা হল। সোনম ওয়াংচুক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত HIAL-এর বিরুদ্ধেও ১.৫ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক রেমিট্যান্স পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৬.৫ কোটি টাকা ওয়াংচুকের বেসরকারি সংস্থা শেশিয়ন ইনোভেশনে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। TOI-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ওয়াংচুক ২০২১-২৪ সালে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে ২.৩ কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছিলেন এবং ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ১.৬৮ কোটি টাকা বিদেশী ফান্ড পেয়েছেন। আরও জানা গেছে, তার নয়টি ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে যার মধ্যে আটটি জানানো হয়নি।

এরপর ২৬শে সেপ্টেম্বর জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হয় সোনমকে। এরপর তাঁকে যোধপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

২৭শে সেপ্টেম্বর, লাদাখ পুলিশের ডিজিপি এসডি সিং জামওয়াল, সোনমের পাকিস্তান সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ওই সমাজকর্মী পাকিস্তানে DAWN-এর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং কেন্দ্রের সাথে রাজ্য গঠনের আলোচনাকে নষ্ট করার চেষ্টা করার চেষ্টা করছিলেন। এমনকি তিনি সোনমের গ্রেপ্তারের সাথে জড়িত একজন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ (পিআইও) কেও গ্রেপ্তার করার এবং সোনমের সাথে বিভিন্ন পাকিস্তানির যোগসূত্র সম্পর্কেও জানান।

তবে আপনাদের জানিয়ে দিই, সোনমের পাকিস্তানে DAWN-এর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু সম্পর্কিত একটি কনফারেন্স। পাশাপাশি তিনি সেই কনফারেন্সে মোদীর প্রশংসাও করেন। যা নিয়ে অনেকেই কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন।

এরপর ১লা অক্টোবর, সোনমের স্ত্রী গীতাঞ্জলি জে. অ্যাংমো জানান, গ্রেফতার করার পর থেকে ৫ দিন কেটে গেলেও তাঁর স্বামীর হালনাগাদ সম্পর্কিত কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি সরকারের তরফ থেকে। এমনকি এই বিষয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুরমুকে একটি চিঠিও লেখেন গীতাঞ্জলি।

https://x.com/GitanjaliAngmo/status/1973375218854031563?

এবার আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখে কী এমন করেছে, যার জন্য এত অনশন, এত প্রতিবাদ?

এরপর ২০১৯ সালের পর থেকেই লাদাখের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঘোষণা করা হয় ৫টি নতুন জেলা, আর তার সাথে ঘোষণা করা হয় ৫টি বড় প্রকল্পের। যে প্রকল্পগুলি সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে লাদাখের ভাগ্য। কিন্তু, এই প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে আম জনতা। কী সেই প্রকল্পগুলি?

প্রথমত, ডারবাক–সায়োক–দৌলত বেগ ওল্ডি (DS–DBO) রোড প্রকল্প

২০০০ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী Darbuk থেকে Daulat Beg Oldie (DBO) পর্যন্ত টানা ২৫৫ কিমি দীর্ঘ এক রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করেন। এই রাস্তা ছিল চিন সীমান্তের একদম কোলঘেঁষা। BJP সরকার পড়তেই বন্ধ হয় সেই কাজ। মোদী আসার পরেই অ্যাডভান্সড পদ্ধতিতে পুনরায় শুরু হয় কাজ। উদ্দেশ্য – যাতে সব মরসুমে ব্যবহার করা যায় এই রাস্তা।

এই রাস্তা সীমান্ত অঞ্চলের নাগরিক জীবন, পণ্য পরিবহন, মেডিকেল সাপোর্টের ক্ষেত্রে অত্যন্ত লাভজনক। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের সময় এই রাস্তা নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। আগে এখানে পৌঁছাতে অনেক দিন ট্রেক করতে হত, কিন্তু এখন সামরিক ট্রাক থেকে শুরু করে ট্যাংক সরাসরি পৌঁছাতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জোজিলা টানেল প্রকল্প

২০০৫ সালে UPA সরকার ঘোষণা করে জোজিলা টানেল প্রকল্পের কথা। কিন্তু, বরাবরের মতো এই প্রকল্প আঁটকে যায় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন কারণে। এরপর ২০১৮ সালে, নরেন্দ্র মোদী আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের পুনরায় ভিত্তি স্থাপন করেন।

জোজিলা টানেল এশিয়ার দীর্ঘতম সড়ক টানেল, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪.১৫ কিমি। এটি শ্রীনগর – কারগিল – লেহ জাতীয় সড়কের অংশ। যার ফলে এটি শ্রীনগর থেকে লেহ যাত্রার সময় কমাবে প্রায় ৩ ঘণ্টা।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, শীতকালে জোজিলা পাস বরফে ঢেকে যায়, ফলত বাইরের বিভিন্ন জায়গার সাথে প্রায় ৫-৬ মাসের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লাদাখ। টানেল সম্পূর্ণ হলে সারাবছর সামরিক সরবরাহ, জরুরি পরিষেবা, পর্যটন ও বাণিজ্য চালু থাকবে। কৌশলগতভাবে ভারত-চিন সীমান্তে দ্রুত সেনা মোতায়েন ও রসদ পাঠানোও সহজ হবে।

তৃতীয়ত, নায়োমা–মুধ এয়ারফিল্ড উন্নয়ন প্রকল্প

১৯৬২ সালে ভারত ও চিনের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল লাদাখের Nyoma নামের একটি অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউণ্ড। কিন্তু, যুদ্ধের পরেই সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু, ২০২৩ সালে রাজনাথ সিং ফের এই জায়গাকে আধুনিক করার জন্য এক নতুন প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। যার মাধ্যমে এটিকে পূর্ণাঙ্গ এয়ারবেস + সিভিল ডুয়াল-ইউজ এয়ারফিল্ড হিসাবে গড়ে তোলা হবে।

এটি LAC-র খুবই কাছে। সেখান থেকে দ্রুত যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার বা পরিবহন বিমান ওঠানামা করতে পারবে। অতীতে লাদাখে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংঘর্ষের পরে এই এয়ারফিল্ড ভারতের জন্য “গেম চেঞ্জার” হতে পারে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে এটি জনগণ ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে।

চতুর্থত, লাদাখে BharatNet, মোবাইল টাওয়ার সম্প্রসারণ ও ব্রডব্যান্ড রোলআউট প্রকল্প

সালটা ২০১১। UPA আমলে BharatNet প্রকল্প শুরু হলেও সমস্যা সেই একই। লাদাখে কাজ হচ্ছিল ধীরগতিতে। ২০১৯ সালে লাদাখ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হওয়ার পর এই প্রকল্পের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা হয়, ফলে গতি পায় প্রকল্প। সারা লাদাখে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে মোবাইল টাওয়ার ও ব্রডব্যান্ড।

পঞ্চমত, সোলার ও উইন্ড প্রকল্প

লাদাখ ভারতের অন্যতম স্থান, যেখানে বছরে প্রায় ৩০০ দিন পরিষ্কার আকাশ থাকে। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখকে “India’s Renewable Energy Hub” বানানোর পরিকল্পনা করে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল, সোলার ও উইণ্ড পাওয়ারকে ব্যবহার করে লাদাখের সাথে উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। তার সাথে সাথেই বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান, হবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আর সফল হবে লাদাখকে “Green Economy Zone” বানানোর সম্ভাবনা।

প্রতিটি প্রকল্প লাদাখবাসীর জন্য যতটা লাভজনক, ততটাই পুরো ভারতের জন্য। কিন্তু, এই সমস্ত প্রকল্পগুলি সফল করার জন্য যেমন কাটা হয় পাহাড়, তেমনই লাগে অনেক জমি। আর তার সঙ্গেই খোদাই করতে হয় রাস্তাও। ওড়ে ধুলো-বালি। আর এই সবই নাকি তাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। আর এটিই হল লাদাখবাসীর বিক্ষোভের অন্যতম কারণ।

কিন্তু, বর্তমানে লাদাখবাসী ঠিক কী কী দাবি করছে? আর সরকার কী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে?

লাদাখবাসীর মোট ৪টি দাবি রয়েছে, যার মধ্যে –

প্রথম এবং মূল দাবি – লাদাখকে স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে।

দ্বিতীয় এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত দাবি – লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করতে হবে, কারণ, রাজ্যের ৯৭ শতাংশ মানুষজন আদিবাসী। সংবিধানের ২৪৪ অনুচ্ছেদের ধারা ২ এবং ২৭৫ অনুচ্ছেদের ধারা ১ অনুযায়ী সংবিধানের ষ্ঠ তফসিল আমাদের দেশের নর্থ ইস্টের ৪টি রাজ্যের আদিবাসীদের জমি এবং সংস্কৃতির সুরক্ষা দেয়। সেগুলি হল অসম, মেঘালয় ত্রিপুরা মিজোরাম। আন্দোলনকারীদের মতে, সরকার এখানে  যে উন্নয়নমূলক কাজ করছে, তাঁর ফলে এখানের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তা বাঁচানোর জন্যই তাদের এই দাবি। কারণ, সম্প্রতি আসামে অধিবাসীদের ৩০০০ বিঘা জমি, বিহারে ২০০০ বিঘা জমি সরকার খুব কম দামে লিজে দিয়েছে। কিন্তু, যাদের আসল অধিকার তারা কিছুই পাচ্ছে না।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের লাদাখের জন্য নিজেদের নির্বাচনী ম্যানিফ্যাস্টে বিজেপি বলেছিল, লাদাখকে ৬ষ্ঠ তফসিলের অধীনে ঢোকাবে, কিন্তু সরকার তা করেনি। তবে, আপনি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, ব্র্যাকেটে শুধু মাত্র অধিবাসী এলাকা লেখা আছে। পাশপাশি অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি যে পালন হয়নি, কিংবা সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়েছে এমনটা নয়, পাশাপাশি অনেক কিছুর কাজ শুরু হয়েছে বা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হচ্ছে।

https://www.instagram.com/p/DPBKmxFk_o0/

তৃতীয় দাবি – লাদাখে আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন চালু করতে হবে, যাতে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা যায়। কারণ জম্মু কাশ্মীর রিক্রুটমেন্ট বোর্ড থেকে লাদাখ আলাদা হওয়ার পর চাকরি ক্ষেত্রে প্রচুর খারাপ পরিস্থিতি চোখে পড়ে। সম্প্রতি সরকারি তথ্য অনুযায়ী, লাদাখে স্নাতক যোগ্যতা আছে অথচ চাকরি নেই এমন জনগণের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ, যা সারা দেশের গড় পরিসংখ্যানের প্রায় দ্বিগুণে

চতুর্থ এবং শেষ দাবি – অতিরিক্ত লোকসভা এবং রাজ্যসভার সিট। বর্তমানে লাদাখে একটি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে দু’টি করার দাবি তোলা হয়েছে।

এবার জানাবো, সরকার লাদাখবাসীর দাবি নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?

সরকার লাদাখবাসীর চার দাবীর মধ্যে শেষ দুটি দাবি ইতিমধ্যেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু, আলাদা রাজ্য এবং ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে সরকারের সাথে দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনা চলছিল লাদাখবাসীর। সরকার জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন কমিটি এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে সরকারের।

সরকার ইতিমধ্যেই লাদাখে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ ৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করেছে। কাউন্সিলের মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করেছে। ভোটি এবং পুর্গিকে সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে, ১,৮০০টি শূন্যপদে নিয়োগও শুরু হয়েছে।

এরপর, ২৫ এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর লাদাখের নেতাদের সঙ্গে ও ৬ই অক্টোবর, এইচপিসি-র সঙ্গে মিটিংয়ের কথা ছিল কেন্দ্রের। কিন্তু, কিছু ব্যক্তি ‘রাজনৈতিক কারণে’ গোটা আলোচনা বানচাল করার চেষ্টা করেছে। আর সেই কারণেই আসন্ন একাধিক মিটিংয়ের ঠিক আগেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে লাদাখে। এমনকি লাদাখের জনগণকে ‘আরব বসন্ত’ কিংবা নেপালের ‘জেন জ়ি’-র প্রসঙ্গ তুলে উস্কে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু, লাদাখবাসীর দাবি কি সত্যি মেনে নেওয়া যায়? এবার কিছু তথ্য তুলে সমস্ত কিছু পরিষ্কার করে দেবো।

প্রথমত, ভারতের সবচেয়ে ছোট রাজ্য হল সিকিম, যার জনসংখ্যা আনুমানিক ৭ লক্ষ। আর অন্যদিকে লাদাখের জনসংখ্যা এখনও ৩ লক্ষও টপকায়নি। তাহলে মাত্র ৩ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে কি একটি রাজ্য গঠন করা যায়?

দ্বিতীয়ত, আমরা আপনাদের জানাবো লাদাখবাসীর এই ষষ্ঠ তফসিলের দাবি কি আদৌ যথাযথ? আমাদের দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের জন্য দুটি তফসিল রয়েছে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ।

পঞ্চম তফসিল দেশের মধ্য ও উপদ্বীপের আদিবাসীদের জন্য। এখানে উন্নয়নের পরিকল্পনা রাজ্যপাল ও স্থানীয় কাউন্সিল মিলে ঠিক করেন।

কিন্তু, ষষ্ঠ তফসিল করাই হয়েছিল দেশের শুধুমাত্র নর্থ ইস্ট রাজ্যগুলির অধিবাসীদের জন্য। কারণ ওই এলাকার আধিবাসীদের জীবন শৈলী, রীতি নীতি, সংস্কৃতি, দেশের অন্যান্য আধিবাসীদের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। এখানে স্থানীয় কাউন্সিলের হাতে থাকে উন্নয়ন, আইন বানানো, এমনকি ট্যাক্স তোলার ক্ষমতাও।

তাহলে, লাদাখ নর্থ ইস্টের রাজ্য না হয়েও, পঞ্চম তফসিল না চেয়ে ষষ্ঠ তফসিল চাইছে কেন? এই উত্তর এখনও পরিষ্কার নয়।

লাদাখে এই তফসিল লাগু হলে, কেন্দ্র সরকারকে প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজের জন্য তাদের থেকে অনুমতি নিতে হবে, এবং তাদের থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে নিতে সময় চলে যাবে।

তৃতীয়ত, লাদাখবাসীর মতে, উন্নয়নমূলক প্রকল্পে তাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কিন্তু, চিন যখন আকসাই চিন এলাকায়, পশ্চিম তিব্বতে, এবং জিনজিয়াং এলাকায় ব্যাপকভাব বিভিন্ন উন্নয়মুলক কাজ, যেমন বাঙ্কার্স তৈরি, বিভিন্ন রাস্তা তৈরি, এয়ার বেস, এয়ার স্ট্রিপ তৈরি, নিজেদের সামরিক সৈন্যদের জন্য লজিস্টিক্যাল সাপ্লাই চেন তৈরি করছিল, তখন এই লাদাখবাসীরা কোনও দাবি তোলেনি কেন? চিনের এই কাজে যে মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড লাদাখের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন কেন কেউ ভারত সরকারকে চিনের বিরোধিতা করতে বলেনি? কেন ভারত সরকারকে চিনের ওই প্রকল্পগুলিকে আটকানোর জন্য জোর দেওয়া হয়নি? যদি দূষণই মূল চিন্তা হয়, তবে তখন এরা কোথায় ছিল? এমনটাই প্রশ্ন করছেন জিওপলিটিক্যাল বিশেষজ্ঞ পভনীত সিং।

চতুর্থত, যদি চিন, ভারতের সীমান্তে এত উন্নত ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে পারে, তাহলে ভারত কেন করতে পারে না? গালওয়ান সংঘর্ষে চিনা সৈন্যকে ভারতীয় সেনা থামাতে পেরেছিল তার অন্যতম মূল কারণ ছিল লাদাখে উন্নয়মূলক বিভিন্ন রাস্তা ও টানেলগুলি। আর গত কয়েক বছরে চিন এবং ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ বিরতি দেখা গিয়েছে, তাঁরও একটাই কারণ লাদাখের ইনফ্রাস্ট্রাকচারে উন্নতি। গালওয়ান উপত্যকায় চিনের আক্রমণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল লাদাখে ভারতের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ আঁটকে দেওয়া। তবে কি সেই আঁটকে দেওয়ার কাজই এখন সম্পূর্ণ করছে লাদাখবাসীরা? তবে কি এর পিছনে রয়েছে চিনের হাত?

পঞ্চমত, এখন আপনাদের জানাবো কারা এই বিদ্রোহ করছে? জিওপলিটিক্যাল বিশেষজ্ঞ পভনীত সিংয়ের মতে, ১৯২০ সাল থেকে চিনের প্রোপাগাণ্ডা উইং ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট একাধিক দেশের উন্নতি থামাতে, বিশেষ করে চিনের স্বার্থবিরোধী কোনও কাজ থামাতে নানা ধরনের প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায়। ভারত এই ডিপার্টমেন্টের কাজ খুব মনোযোগ সহকারে স্টাডি করছে। এরা ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই প্রোপাগাণ্ডা ক্যাম্পেন চালাচ্ছে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য, লাদাখ আর কাশ্মীরে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাজ বন্ধ করা, এবং প্রতিবাদ করানো।

ষষ্ঠত, লাদাখের প্রতিবাদকারীদের আরও একটি চিন্তার কারণ দেশের জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি জিনিস যা বৈশ্বিক সমস্যা। তথ্য বলছে, ইউরোপে উন্নয়নের নামে এত ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে, পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে, যে তাঁর দাম আমাদের ভারতীয়দের চোকাতে হয়। অর্থাৎ, আমাদের বলার উদ্দেশ্য, যদি আজ ভারত কোনওরকম উন্নয়নমূলক কাজ না করে, চুপ করে বসে থাকে, তবে চিনে করা কাজের প্রভাবে ক্ষতি হবে সারা বিশ্বের জলবায়ু, তেমনই ভারতের করা কাজের প্রভাবে ক্ষতি হবে সারা বিশ্বের। কিন্তু, যদি আমরা এইভাবে উন্নয়নমূলক কাজ না করি তখন এরম না হয়, যে চিন আমাদের থেকে লাদাখকেও কেড়ে নিল!

সপ্তমত,

অষ্টমত, আমরা ডিপ স্টেটের ভিডিওতে আলোচনা করেছিলাম কীভাবে কোনও দেশের কাউকে হিরো বানানো হয়, আর সরকারকে ভিলেন বানানো হয়। সোনম ওয়াংচুক একজন বিজ্ঞানী, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার আবার সমাজসেবী অর্থাৎ তিনি দেশের হয়ে একাধিক ভালো কাজ করেছেন। তাঁর জন্য লোকের মনে ভালোবাসা এবং সম্মান রয়েছে। পাশাপাশি তাঁকে, ২০১৪ সালে, CRATerre France-এর তরফ থেকে Unesco Chair In Earthen Architecture-এর সম্মান দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের রোলেক্স সংস্থার তরফ থেকে Rolex Award for Enterprise দেওয়া হয়। ওই বছরেই আন্তর্জাতিক টেরা সংস্থার তরফ থেকে দেওয়া হয় International Terra Award for Best Earth Building। ২০১৮ সালে এশিয়ার “নোবেল” হিসেবে খ্যাত ফিলিপাইন্স থেকে Ramon Magsaysay Award দেওয়া হয়।

অর্থাৎ আমাদের বলার উদ্দেশ্য এখানে ডিপ স্টেটের একটি প্যাটার্ন লক্ষ করা গিয়েছে। কাউকে হিরো বানানো হয়েছে, এবং সম্প্রতি তাঁকে সরকার জেলে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনুসকেও নোবেল দিয়ে এই ভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিল আমেরিকা। জানলে অবাক সোনম এবং ইউনুস, এই দুজনকেই Ashoka Fellows–এর তালিকায় রাখা হয়েছে, যা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা সামাজিক উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রবন্ধ ও সেমিনারে Sonam Wangchuk-কে ড. Yunus-এর ধাঁচে “ভারতের Social Innovator” বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ইউনুস যেমন দারিদ্র্য ও ক্ষুদ্রঋণে বিশ্বজোড়া প্রভাব ফেলেছেন, ওয়াংচুকও তেমনভাবে শিক্ষা ও পরিবেশ উদ্ভাবনে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।

আমরা সোনম ওয়াংচুককে দোষী বলছি না, আমরা শুধুমাত্র একটি প্যাটার্ন এবং তাঁর সমাজের প্রতি ভালো কাজের বিভিন্ন দিক যেমন তুলে ধরলাম, তেমনই তুলে ধরলাম তাঁর দাবি কতটা যথাযথ সেই বিষয়ে। বাকী বিচার আপনাদের। আপনাদের কী মনে হয়? কে ভুল? কে ঠিক?

গুরুত্বপূর্ণ
Join
চাকরির খবর
Join
রাশিফল
Join
খেলার খবর
Join