শিবানী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ “শ্যামাধন কি সবাই পায়?” – এই প্রশ্ন যখন বাঙালির চেতনায় জেগে ওঠে তখন জেগে ওঠেন সাধকশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যও (Pannalal Bhattacharya Untold Story)। চলে যাওয়ার এতো দিন পরেও বাঙালির মাতৃ সাধনায় অবিচ্ছেদ্যে রয়ে যান পান্নালাল – তাঁর শ্যামা সংগীতে। নিজের খুল্লমাতামহ – এই পান্নালাল ভট্টাচার্যকে নিয়েই পান্নালালের জীবনের এক আশ্চর্য কাহিনি শোনালেন ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ এক অলৌকিক ঘটনা। তখনও পান্নালাল ভট্টাচার্য – পান্নালাল ভট্টাচার্য হয়ে ওঠেন নি। তখন তিনি অনেকটাই ছোট। মা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে গিয়েছেন নদিয়ার নবদ্বীপের প্রখ্যাত পোড়ামাতলা মন্দিরে। অদূরেই ভবতারিণী মন্দির। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর বড় বৌদি – বড় দা, সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের স্ত্রী পুষ্পরানি ভট্টাচার্য। পুষ্পরাণি ছিলেন নবদ্বীপেরই ভূমিকন্যা। বাগচী বাড়ির বিভূতিভূষণ বাগচীর একমাত্র কন্যা। আবার এই নবদ্বীপেই বিয়ে হয়েছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেজদি ভগবতী দেবীর, নবদ্বীপ রায় পরিবারের সুধাংশু রায়ের সঙ্গে। এই দুই সংযোগেই নবদ্বীপে আসতেন অন্নপূর্ণা দেবী। সঙ্গে আসতেন পান্নালাল।
শিবানী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের ভাইঝি) মতে, সেবার ঘটেছিল এক আশ্চর্য কাণ্ড। মায়ের মন্দিরে পুজো দেওয়ার সময় হঠাৎই দেখা গেল পান্নালালের এক ভাবলেশহীন অবস্থা। কিছুক্ষণ পরে শুধু দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে। কিন্তু কোনও কথা নেই। মা এবং বৌদি দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন নিশ্চিতভাবে কোনও অসুস্থতার লক্ষণ এটা। এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন মন্দিরের পুরোহিত। তিনি পান্নালালকে দেখে বললেন, তুই কেন এলি বাবা? তোর তো এখানে আসার কথা নয়! পান্নালাল ভট্টাচার্যের মা এবং বৌদি দুজনেই তাকিয়ে রইলেন পুরোহিতের দিকে। বুঝতে পারলেন না তাঁর কথার অর্থ। এবার পুরোহিত মশাই নিজেই বললেন তাঁদের, তোরা ভাগ্যবান মা। ও মস্ত বড়ো সাধক। কিন্তু ও তো তোদের মধ্যে বেশিদিন থাকবে না রে মা।
এগারো ভাই-বোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন পান্নালাল। তিনি যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে, তখনই তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অকালে প্রয়াত হন। সুরেন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন ভাদুড়ী বংশের সন্তান। শোনা যায়, বর্ধমানের মহারাজার কাছ থেকে তাঁরা ভট্টাচার্য উপাধি পান। সুরেন্দ্রনাথ সারাজীবন সেই ভট্টাচার্যই ব্যবহার করেছিলেন। পারিবারিক মনোমালিন্যের কারণে পায়রাটুঙ্গির জমিদারির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে একসময় চলে এসেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ – হাওড়ার বালিতে। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি দখল নেওয়ার কথা একবারও ভাবেননি অন্নপূর্ণা দেবী। তাই সন্তানদের নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ছিলই।
এরই মধ্যে সংগীতের আঙিনায় প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলেন তাঁর দুই ছেলে। সুরকার হিসেবে বড় ছেলে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য এবং সংগীত শিল্পী হিসেবে মেজ ছেলে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। এই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের চেষ্টা, উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় সেদিনের সেই পান্নালালই একসময় হয়ে উঠলেন কে. মল্লিক, মৃণালকান্তি ঘোষ, ভবানীচরণ দাস প্রমুখ সেকালের প্রখ্যাত শিল্পীদের পরে বাংলা শ্যামা সংগীত ধারার জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর গান মানে ভক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। জলে ভরা দুচোখে মাতৃ আবাহন। কিন্তু সত্যি হলো সেদিনের সেই পুরোহিতের কথা। দিন যতো গড়াতে থাকল, জীবনে যতোটা পরিণতির দিকে এগোতে থাকলেন পান্নালাল – ততোই আসতে থাকল পরিবর্তন।
যে জীবনে মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো, মোহনবাগানের ফুটবল খেলা দেখতে যাওয়া, রান্না করা ছিল জীবনের অনেকটা জুড়ে – সেই জীবন থেকে আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকলেন পান্নালাল। তাঁর কাছে তখন সময় মানে – ঘণ্টার পর ঘণ্টা গঙ্গার ধারে একা বসে মাকে ডাকা। সবার চোখের আড়ালে একেবারে গোপনে মাতৃ সাধনা। কোথাও যেন বইতে থাকল সাধনার বংশগত উত্তরাধিকার। তাঁর পরিবারের পুরুষোত্তম -“The Levitating Saint” ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ অথবা ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর মতো সংগীতের ভুবনে গেলেও তাঁদের মতো সন্ন্যাস কিংবা ব্রহ্মচারীর জীবনে গেলেন না বটে পান্নালাল, কিন্তু স্বল্পকালীন জীবনের শেষ পর্বটা শ্মশানে শ্মশানে কেঁদে কেঁদেই কাটিয়ে দিলেন পান্নালাল। কখনও বারেন্দ্র পাড়ার শ্মশান ঘাটে, কখনও কেওড়াতলায়, কখনও বা সিরিটিতে। তাঁর জগতে তখন শুধু তিনি আর মা ভবতারিণী। মা আর ছেলের মাঝখানে খ্যাতি, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সমাজ, সংসার, স্ত্রী, কন্যা – কেউ নেই! কিচ্ছু নেই! ১৯৬৬ -তে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে চলে গেলেন পান্নালাল। তাঁর শেষ গানের কলিতে তখনও – “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে…”