ড.শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ আজ তিনি পূজিত হন বাঙালির ঘরে ঘরে। অথচ এক সময় এই দেবীর আরাধনা সীমাবদ্ধ ছিল একশ্রেণির কাপালিকের মধ্যে। গভীর রাত্রির ঘন অন্ধকারে তাঁদের সাধনা আর তন্ত্রের প্রয়োগগত রহস্যময়তা কোথায় যেন এঁকেছিল দূরত্বের ছবি। সেই দূরত্বই ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন মহাসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয়েছিল দেবীর আরাধনা। সত্য হয়ে উঠেছিল – “কালিকা বঙ্গদেশে চ”।
এই দেবীই জ্যোতির্ময়ী আদ্যা শক্তি। চণ্ড বধের সময় দেবীর মুখ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠলে তাঁর ললাট থেকে যে দেবীর আবির্ভাব ঘটে – তিনিই এই দেবী – কালী। দেবী কালী আসলে দেবাদিদেব মহাদেবেরই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ – দেবী পার্বতীর ধ্বংসাত্মক রূপ। ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবীসহ সপ্ত মাতৃকা তাঁরই রূপান্তর। এঁদের সবারই সংযোগ অগ্নিরূপী শিবের সঙ্গে।
রক্তবীজ বধের সময় এই কালীই জিহ্বা বিস্তার করে রক্তবীজের সমস্ত রক্ত পান করেছিলেন। কৌষিকীর অস্ত্র প্রহারে বিনষ্ট হয়েছিল রক্তবীজ। ইনিই ব্রহ্মার শক্তিরূপে ব্রহ্মাণী, বিষ্ণুর শক্তিরূপে বৈষ্ণবী এবং শিবের শক্তি রূপে শিবানী। সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণের প্রতীক হিসেবে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কালী।
তন্ত্র গ্রন্থে অসংখ্য মহাশক্তির উল্লেখ আছে :” শত লক্ষ মহাবিদ্যা তন্ত্রাদৌ কথিতা প্রিয়ে। ” – এরমধ্যে প্রধান দশ মহাবিদ্যা। কালী দশ মহাবিদ্যার প্রথম দেবী। এই দেবী সম্পর্কে বলা হয়েছে : সমস্ত প্রাণী, সমস্ত সৃষ্টিকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলে তাঁর নাম মহাকাল। সেই মহাকালকে- শিবলিঙ্গকে তুমি গ্রাস কর, আত্মদেহস্থ করতে পারো বলে তোমার নাম পরা কালিকা। তুমি কালকে গ্রাস করো — তাই তুমি কালী। –
“কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীৰ্ত্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা ॥
কালসংগ্ৰসনাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী ।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে॥”
এই দেবীরই দক্ষিণ পদ শবের ওপর আর বাম পদ রয়েছে শৃগালের ওপর –
“নিক্ষিপ্য দক্ষিণং পাদং সন্তিষ্ঠৎ কুণকোপরি।
বামপাদং শৃগালস্য পৃষ্ঠে ফেরুশতৈর্বৃতম্।।”
-দেবী যে শ্মশানবাসিনী।
আমাদের বাংলার ঘরে ঘরে যে দেবীর পুজো হয় – তিনি দক্ষিণা-কালী। ধ্যানমন্ত্র অনুসারে তিনি করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে অবস্থান করছে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ। এবং দক্ষিণকরযুলে দেবী বর ও অভয় মুদ্রা প্রদান করছেন। এই দেবী দিগম্বরী। তাঁর গাত্রবর্ণ মূলত কালো।
কার্তিক মাসের অমাবস্যার অর্ধ রাত্রিতে এই দেবীর আরাধনায় মাতেন সর্বস্তরের বাঙালি। এই অর্ধ রাত্রিই দেবীর পুজোর মুখ্য কাল। কারণ – এই সময়ে স্বয়ং দেবী কোটি যোগিনী পরিবৃত হয়ে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই এই তিথির অর্ধরাত্রে দেবীর আরাধনা করলে সাধক সর্বসিদ্ধি লাভ করেন :
“কার্ত্তিকে কৃষ্ণপক্ষে তু পঞ্চদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনীকোটিভিঃ সহ ॥
অতোঽত্ৰ পূজনীয়া সা তস্মিন্নহনি মানবৈঃ।
বলিপূজাদিকং সৰ্ব্বং নিশায়াং ক্রিয়তে তু যৎ ।
তত্তদক্ষয়তাং যাতি কালী বিদ্যা প্রসীদতি ॥”
অবশ্য এক্ষেত্রে চতুর্দশীযুক্ত অমাবস্যা গুরুত্বপূর্ণ। এই তিথিই অর্ধরাত্রিকালে দেবী পুজোর জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত বলে কথিত। এক্ষেত্রে যদি মঙ্গলবার এবং শনিবারের সংযোগ হয় – তাহলে এই পুজো আরও ফলপ্রদ।
দেবীর আরাধনার ক্ষেত্রে মহানিশা এবং মহাতিনিশারও ভূমিকা আছে। সূর্যাস্তের এক প্রহরের পরের দু ঘটিকা হলো মহানিশা এবং তার পরবর্তী কালকে বলে মহাতিনিশা। দেবীর ভাবভিত্তিক পুজোর ক্ষেত্রে এই মহানিশা এবং মহাতিনিশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মহানিশা কালেই তান্ত্রিকরা বিধি মেনে পুজো এবং জপে নিজেদের নিযুক্ত করেন। এক্ষেত্রে মহাবিদ্যাকে প্রসন্ন করারও বিষয় আছে। মহাবিদ্যা প্রসন্ন হলে সাধক বীরভাব লাভ করেন। বীরভাবের প্রসাদে আবার প্রাপ্তি ঘটে দিব্য ভাবের। বীর এবং দিব্য ভাব হলো মহাভাব।
কলিতে কালীপুজো সর্বফলপ্রদ। আর কালীর সাধক ধন্য। কলিতে পরম কর্তব্য কালীকে স্বহৃদয়ে ধ্যান করে জগজ্জননীর পুজো করা :
“স ধন্যঃ স চ বিজ্ঞানী স এব সুরপূজিতঃ।
সব দীক্ষিতঃ সুখী সাধুঃ সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়।।
স বেদবক্তা স্বাধ্যায়ী সর্ব্বানন্দপরায়ণঃ। স্বস্মিন্ কালীন্তু সম্ভাব্য পূজয়েজ্জগদম্বিকাম্।।”
বাঙালির ঘরে ঘরে মা কালীর যে পুজো তার মধ্যে কার্তিকের অমাবস্যার পুজো না করলে প্রত্যবায় হয়। তাই এই পুজো অবশ্য করণীয়।