ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ তিনিই সৃষ্টি করেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তিনি আদি শক্তির মূর্ত রূপ। বাংলায় তাঁর প্রথম প্রতিমা পুজোর সূচনা হয় নবদ্বীপের সিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে। অনুমান করা হয় – তার আগে এই দেবী কালীর পুজো অবশ্যই প্রচলিত ছিল। তবে তা হতো মূলত যন্ত্রে। দেবী কালীর পুজোকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার জমিদার এবং সম্পন্ন পরিবারগুলোতে কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। আর আজ তো দেবী পূজিত হন বাংলার ঘরে ঘরে।
বাংলায় সবচেয়ে বেশি দু’টি রূপে পূজিত হন মা
প্রতিমায় দেখা যায় – কোথাও দেবীর ডান পা এগিয়ে, আবার কোথাও বাঁ পা। এই ডান পা এগিয়ে থাকলে – দেবী দক্ষিণা কালী। সাধারণভাবে বলা হয়, মা কালীর এই রূপের ভয়ে দক্ষিণদিকের অধিপতি যম পলায়ন করেন, তাই দেবী দক্ষিণাকালী। আবার কোথাও দেখা যায় – দেবীর বাঁ পা অগ্রবর্তী। দেবী এইরূপে বামা কালী।
বাংলার ঘরে ঘরে দেবীর যে রূপের আরাধনা হয় – সেখানে দেখা যায় দেবীর পদতলে রয়েছেন স্বয়ং মহেশ্বর। তাঁর ওপর একটি মাত্র পা রেখেছেন দেবী, আচরণের সেই লজ্জায় দেবী জিভও কেটেছেন। বাইরে বেরিয়ে পড়েছে সেই জিভের অগ্রভাগ। বাঙালির মাতৃ পুজোর সময় আজও বাঙালির হৃদয়ের সংগীতে সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের ভক্তি নিবিড় কণ্ঠে শোনা যায় :
“অসিতে রুধির ধারা, গলে মুণ্ডমালা,
হেঁট মুখে চেয়ে দেখো, পদতলে ভোলা ।”
দক্ষিণাকালীর ধ্যানেও আছে :
“শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরি সংস্থিতাম্।।
শিবাভির্য্যোররাবভিশ্চতুদিক্ষু সমন্বিতাং।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাং।।”
রক্তবীজকে যুদ্ধে পরাজিত করে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন দেবী। শুরু করে দেন ভয়ঙ্কর নৃত্য। ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায় চারদিকে। ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয় সম্পূর্ণ সৃষ্টির। বাধ্য হয়ে দেবতারা ছোটেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। কারণ দেবী কালীকে এই অবস্থায় একমাত্র শান্ত করতে পারেন শিব। জগতের মঙ্গলের জন্য সেই চেষ্টাই করলেন শিব। শুয়ে পড়লেন দেবীর সামনে। নৃত্যরতা মা কালী শিবের বুকে পা দেওয়ার পর সম্বিৎ ফিরে পেলেন। স্বামীর বুকে পা দেওয়াতে লজ্জায় বেরিয়ে এলো তাঁর জিভ।
কিন্তু এর পেছনে আছে গভীর তত্ত্ব। দেবীর পদতলে থাকা শিব কিন্তু আসলে শব! দেবী কালীর বাম পদ রয়েছে শৃগালের ওপর আর দক্ষিণ পদ তো শবের ওপরেই বিদ্যমান –
“নিক্ষিপ্য দক্ষিণং পাদং সন্তিষ্ঠৎ কুণকোপরি।
বামপাদং শৃগালস্য পৃষ্ঠে ফেরুশতৈর্বৃতম্।।”
শক্তি ছাড়া শিব যে অচল। তখন সে শবদেহের রূপ নেয়। দেবীই তো ব্রহ্মার শক্তিরূপে ব্রহ্মাণী, বিষ্ণুর শক্তিরূপে বৈষ্ণবী এবং শিবের শক্তি রূপে শিবানী। শব-শিবের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত তাঁরই চরণ। সাধকের কাছে এর অর্থ – সাধকের মন যখন বাহ্যিক জগতের সবকিছুকে উপেক্ষা, অস্বীকার এবং ত্যাগ করে সাধনসিদ্ধ পর্যায়ে শবদেহে পরিণত হয়, তখনই তাঁর হৃদয় হয়ে ওঠে মায়ের মন্দির। সেখানেই অবস্থান করেন মা কালী। বাস্তবে, যেখানে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ক্রিয়া করেন – শিবশক্তি সমন্বিত তিনিই তো সাধকের ইষ্ট দেবী :
” শুন্যরূপং শিবং সাক্ষাদিন্দুং পরমকুণ্ডলীম্।
সার্দ্ধত্রিবলয়াকার কোটিবিদ্যুৎসমপ্রভা।।”