কৃশানু ঘোষ, কলকাতাঃ ১৫২৬ সাল থেকে শুরু দীর্ঘ ৩৪১ বছর ধরে শুধু ভারত নয় বলা ভালো অর্ধেক এশিয়া শাসন করেছে মুঘলরা। এরপর ১৮৫৭ সালে মুঘলদের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ দ্বিতীয়কে সিংহাসনচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠায় ব্রিটিশরা। রেঙ্গুন অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাঁকে। ফলত ভারতে শেষ হয় মুঘল সাম্রাজ্য। কিন্তু আপনারা কি জানেন, মুঘল সাম্রাজ্য শেষ হলেও শেষ হয়নি মুঘলদের বংশধররা (Mughal Heir)। বরং জানলে অবাক হবেন, তারা আমার আপনার মতো, আমার আপনার সাথেই কলকাতাতে বসবাস করেন! কী অবাক হচ্ছেন? চলুন আপনাদের আজ জানাই এক অজানা তথ্য সম্পর্কে।
কলকাতার কোথায়, কেমনভাবে আছে মুঘলদের বংশধররা?
এক সময়ে জাঁকজমকপূর্ণ মহলে থাকতো যে পরিবার, এখন তাদের উত্তরাধিকারী বসবাস করে কলকাতার অন্যতম দরিদ্র এলাকা হাওড়ার দুই কামরার একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে। একসময়ে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক ছিলেন যারা, এখন তাদেরই বর্তমান প্রজন্ম – কাচা-ধোয়া এবং ব্যবহারেরর জন্য নির্ভরশীল রাস্তার কলের উপর। যে সাম্রাজ্যের সম্রাটরা একদা যাপন করতেন বিলাসিতাপূর্ণ জীবন, এখন সেই বংশ ভাগ করে নেয় প্রতিবেশীদের সাথে একই রান্নাঘর। আর এমনভাবেই আছেন মুঘলদের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ দ্বিতীয়র প্রপৌত্রী সুলতানা বেগম।
কে ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ?
১৮৩৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট হিসাবে সিংহাসনে বসেন বাহাদুর শাহ দ্বিতীয়। যিনি ছিলেন সুলতানার প্রপিতামহ। যিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৭৭৫ সালের ২৪শে অক্টোবর দিল্লিতে। একজন শাসক হিসাবে বাহাদুর শাহ জনপ্রিয় না হলেও, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজের কবিতা, সঙ্গীত এবং ক্যালিগ্রাফির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি “জাফর” ছদ্মনাম ব্যবহার করে একাধিক লেখা লিখেছেন।
আরও পড়ুনঃ India Hood Decode: জয় শাহ কীভাবে বদলে দিলেন ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের ভাগ্য?
১৮৫৭ সালে জাফরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ব্রিটিশরা তাঁকে বন্দী করেন। এরপর ১৮৫৮ সালে তাকে রেঙ্গুনে (বর্তমান মায়ানমার) নির্বাসন করে দেওয়া হয়। নৃশংসভাবে খুন করা হয় সম্রাটের পরিবারের একাধিকজনকে। যার মধ্যে ছিলেন সম্রাটের দশ জন পুত্রও। যার পর অনেকেই জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায় উদয়পুরে, অনেকে আশ্রয় নেন হায়দ্রাবাদে, আবার অনেকেই চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে।
এর মধ্যে একজন ছিলেন ভারতের শেষ মুঘল শাসকের প্রপৌত্র মির্জা মোহাম্মদ বেদার বখত। আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন সুলতানা বেগম। ১৯৬৫ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুলতানা বেগম নিজের চেয়ে ৩২ বছরের বড় মির্জা মোহাম্মদকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের ছয় সন্তান ছিল। ১৯৮০-র দশকে মির্জা মোহাম্মদ বেদার বুখতের মৃত্যুর পর সুলতানার জীবনে আসে নাটকীয় পরিবর্তন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে উপার্জনের একমাত্র উপায় ছিল পেনশনের টাকা, যার পরিমাণ ছিল মাসিক ৬,০০০ টাকা। এই টাকায় তার ছয় সন্তান এবং নিজের খরচ চালানো ছিল সুলতানার জন্য খুবই কঠিন। রাজপরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, সুলতানা সরকারের কাছ থেকে কখনও কোনও সহায়তা পাননি।
তবে বেসরকারি বেশ কিছু সংস্থা এবং NGO-র কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য পেয়েছেন সুলতানা, তবের আর্থিক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। এক সময়ে চায়ের দোকান চালানো, মহিলাদের পোশাক তৈরির কাজ শুরু করলেও, সেই উপায়ও স্থায়ী হয়নি বেশি দিন।
পুনরায় শিরোনামে আসেন কবে? কীভাবে?
সম্প্রতি, অবহেলা এবং আড়ালে থাকা মুঘল সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ২০২১ সালে সংবাদের শিরোনামে আসেন, যখন তিনি লাল কেল্লার বৈধ মালিক হিসেবে নিজেকে দাবি করেন এবং লাল কেল্লার স্বীকৃতি চেয়ে আদালতে মামলা করেন। এবং তিনি নিজেকে বৈধ উত্তরাধিকারী হিসাবে ভারতের শেষ মুঘল শাসকের প্রপৌত্র মির্জা মোহাম্মদ বেদার বখতের সাথে নিজের বিবাহের নথি জমা দেন। তিনি আদালতে জানান, যে ভারতের সরকার তাঁর সম্পত্তির অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে, এবং শীঘ্রই তাকে হস্তান্তর করা উচিত।
তবে, দিল্লি হাইকোর্ট সুলতানার এই আবেদনকে “সময়ের অপচয়” বলে খারিজ করে দেয়। তবে, সুলতানা বেগম আদেও রাজবংশের উত্তরাধিকারী কিনা সেই বিষয়ে রায় দেয়নি। তবে আদালত সুলতানা বেগমের আইনজীবী বিবেক মোরেকে জানিয়েছে যে, জাফরের নির্বাসনের পর ১৫০ বছর কেটে গেলেও জাফরের বংশধররা কেন এই ধরনের কোনও মামলা দায়ের করেননি? এবং তার ন্যায্য কোনও প্রমাণ জমা দেয়নি?
তবে, সুলতানা এবং তাঁর আইনজীবী হাইকোর্টের এই মামলাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, “আমি আশা করি আজ, কাল অথবা ১০ বছর পরে হলেও, আমি আমার প্রাপ্য অধিকার পাবো… নিশ্চিতরূপে আমার ন্যায়বিচার হবে।”
যদিও সম্প্রতিকালে অনেকেই নিজেদের মুঘল উত্তরাধিকারী বলে দাবি করেন।
তবে, এত কিছুর পর যদি সুলতানা বেগমের দাবি সত্যি হয়, সরকার কি তার দায়িত্ব নেবে?












