India Hood Decode: আমেরিকার ট্যারিফ রহস্য ফাঁস, এবার অ্যাকশন ভারতের

Published on:

Updated on:

India US Tariff War

ট্যারিফ, ট্যারিফ আর ট্যারিফ। গত কয়েক মাসে এই একটা শব্দে তোলপাড় সারা বিশ্ব। কোথাও ২৫, কোথাও ৫০ আবার কোথাও বা ১০০ শতাংশ ট্যারিফ প্রয়োগ করছে আমেরিকা। আর এবার ভারতের ওপরে সেই শুল্কবাণ নিক্ষেপ করল ট্রাম্প (India US Tariff War)।

কেউ কেউ ইতিমধ্যেই মাথা নত করেছে আমেরিকার কাছে, আবার কেউ হাত মিলিয়ে কমিয়েছে শুল্কের পরিমাণ। কিন্তু, আমেরিকার এই শুল্ক নীতির কাছে কোনভাবেই মাথা নোয়াতে রাজি নয় ভারত। কারণ, জানলে অবাক হবেন – এই শুল্ক যুদ্ধের সূচনা প্রথম ভারতই করেছিল!

এক সময়ে যে ট্রাম্প ছিলেন ভারতের প্রশংসক, সবসময় বন্ধু বলতেন ভারতকে, আজ সেই ট্রাম্পই কেন হয়ে উঠেছেন ভারত বিরোধী? কী উদ্দেশ্য রয়েছে এর পিছনে? কোনও কূটনীতি, নাকি ভয়? আজ এক এক করে ভারতের ওপর এই শুল্ক নীতির সমস্ত কারণ ডিকোড করবে India Hood।

ট্যারিফ কী?

ট্যারিফ, বাংলায় এর অর্থ শুল্ক, এটিকে এক ধরনের TAX-ও বলতে পারেন। বিভিন্ন দেশ যখন অন্য দেশ থেকে কোনও জিনিস কেনে, তখন তার ওপর ট্যারিফ বা শুল্ক চাপানো হয়। ধরুন আমেরিকা, ভারতে ১০,০০০ টাকা মূল্যের একটি ফোন রফতানি করল, আর ভারত ওই পণ্যে ৫০ শতাংশ ট্যারিফ লাগু করল। অর্থাৎ, এবার ভারতে ওই ফোনের দাম হবে ১৫,০০০ টাকা।

ইন্ডিয়াহুডের বিশেষ প্রতিবেদন

এই শুল্ক লাগু করার পেছনে রয়েছে মূলত দুটি কারণ। একটি হল দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি করা, আর অন্যটি হল দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা। কারণ ট্যারিফের কারণে বাইরে থেকে আসা জিনিসের দাম বেড়ে যায়, কিন্তু দেশের তৈরি জিনিসের দাম তার তুলনায় অনেক কম থাকে, যা অধিকাংশ মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়।

ট্যারিফ যুদ্ধের ইতিহাস!

অনেকেই ভাবছেন এই ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু ২০২৫ থেকে। কিন্তু না, এই যুদ্ধ শুরু ২০১৪ সালের ২৬শে মে। যখন ভারত মোটা শুল্ক চাপায় আমেরিকা থেকে আসা ২৮টি পণ্যের ওপর। লোহা ও লৌহজাতীয় পণ্যে ২৭.৫ শতাংশ, অন্যদিকে ছোলা ও মুসুর ডালের ওপর ৭০ শতাংশ অবধি শুল্ক বসানো হয়।

এরপর ২০১৮ সালের মার্চ মাস, ১৯৭৬ সালে চালু হওয়া GSP প্রকল্পে ভারতকে রাখা হবে কিনা তার বিবেচনা শুরু করে আমেরিকা। এই প্রকল্পের অধীনে ভারত নিজেদের ৩,৫০০টি পণ্য কোনরকম শুল্ক ছাড়াই আমেরিকায় বিক্রি করতে পারত।

কিন্তু, জো বাইডেন প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত যুক্তি দেখিয়ে ভারতের কয়েকটি ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের উপরে যথাক্রমে ২৫% এবং ১০% আমদানি শুল্ক চাপায়। এর পাল্টা হিসাবে, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী সুরেশ প্রভু বিভিন্ন মার্কিন পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক বসায়। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে এই পদক্ষেপে স্থগিতাদেশ লাগানো হয়।

এরপর ২০১৯ সালের ৫ই জুন, ভারতকে, আমেরিকার জিএসপি সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সাথে জানানো হয়, ভারত, মার্কিন পণ্যের ক্ষেত্রে “ন্যায্য বাজার” দিচ্ছে না। এর পাল্টা ভারতও, আমেরিকা থেকে আসা ২৮টি পণ্যের উপরে শুল্ক চাপায়। কিন্তু, ২০২০ সালে সমঝোতার মাধ্যমে শুল্ক প্রত্যাহার করে দু’পক্ষই।

এরপর ২০২৫ সালের ২০শে জানুয়ারি, রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়েই একের পর এক দেশে শুল্ক আরোপ করা শুরু করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানান, ঘরোয়া উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যেই শুল্ক আরোপ করা হবে সমস্ত দেশে।

এরপর ২০২৫ সালের ৬ই মার্চ, ভারতীয় পণ্যের ওপরেও সম মূল্যের শুল্ক চাপানোর ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প। জানিয়ে দেন, আগামী ২রা এপ্রিল থেকে ভারত থেকে আমদানি হওয়া ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, টেলিকম যন্ত্রাংশ, বস্ত্রপণ্য এবং মুল্যবান পাথরের ওপর শুল্ক চাপানো হবে।

এর ২৫ দিন পর ৩১শে মার্চ, ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন, “যে সমস্ত দেশ রাশিয়া থেকে তেল কিনবে তাদের উপরেও ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানো হবে।“

এরপর ৩রা এপ্রিল, বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন ট্যারিফ লাগু করে আমেরিকা। যার মধ্যে ভারতের ওপর চাপানো হয় ২৬ শতাংশ শুল্ক। কিন্তু ৯ই এপ্রিল, হঠাৎ করেই চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপর থেকে আমেরিকার নয়া শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

এরপর ৫ই মে, আমেরিকার বাইরে প্রযোজিত যে কোনও সিনেমার উপর ১০০ শতাংশ কর চাপানো হয়, যার মধ্যে ছিল ভারতও। এর পাল্টা ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “আমেরিকার মেক আমেরিকা গ্রেট এগেনের নীতির মতোই এবার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ এবং ‘বিকশিত ভারত’-এর নীতি নিয়ে এগোবে ভারত।“

এরপর দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, এবং বৈঠক সারার পর বড়সড় পদক্ষেপ নেয় ভারত। এবার আমেরিকা থেকে ভারতে আমদানি হওয়া ২৯টি পণ্যের ক্ষেত্রে যে সমস্ত আর্থিক ছাড় ভারত দিত, তা স্থগিত রাখার এবং নতুন শুল্ক বসানোর বার্তা দেয় মোদী সরকার।

এরপর ৩১শে মে, আমেরিকার তরফ থেকে ভারত সহ বিশ্বের সমস্ত দেশের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়।

এরপর জুলাই মাসের শুরুতে, ফের রাশিয়াকে শুল্ক যুদ্ধে টেনে আনে আমেরিকা। ১লা জুলাই, মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল পেশ করা হয়, যেখানে বলা হয় – আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যদি কোনও দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে, তবে সেই দেশের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে। ওই দিনই সেই বিলকে সমর্থন জানায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

৯ জুলাই শুল্ক চাপানোর নতুন তারিখ ১লা আগস্ট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, ১লা আগস্ট, ট্রাম্প জানান, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক লাগু হল, তবে নয়া এই শুল্ক চালু হবে ৭ই আগস্ট থেকে।

এরপর ৭ই আগস্ট নতুন শুল্ক আরোপ করার আগে, ৬ই আগস্ট একটি নতুন অর্ডারে স্বাক্ষর করে আমেরিকা। সেই অর্ডারে বলা হয়, আগামী ২৭শে আগস্ট থেকে ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করার জন্য আরও ২৫ শতাংশ জরিমানা শুল্ক দিতে হবে। অর্থাৎ, ভারত থেকে আমেরিকায় রফতানি করা নতুন শুল্কের হার ৫০ শতাংশ।

ভারতের ওপর ট্যারিফ চাপিয়ে কী লাভ আমেরিকার?

প্রথমত, ভারত বহুদিন ধরেই আমেরিকার ডেয়ারি সহ বিভিন্ন পণ্য থেকে মোটা শুল্ক আদায় করে আসছে। যার কারণে মার খাচ্ছে মার্কিন  রফতানি। এখন আমেরিকার উদ্দেশ্য ট্যারিফ চাপিয়ে ভারতের তরফ থেকে শুল্ক কমানো।

দ্বিতীয়ত, মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন অর্থাৎ আগের মতো আমেরিকাকে বিশ্বসেরা বানাতে এই ধরনের কূটনীতির প্রয়োগ করছে আমেরিকা। কারণ এই ট্যারিফের চাপ দিয়ে বিভিন্ন দেশ সহ ভারতকে নিজের আঙুলে নাচাতে চাইছে ট্রাম্প।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন দেশের ওপর ট্যারিফ বাড়ালে বিদেশি পণ্যের দাম বাড়বে আর দেশীয় পণ্যের দাম কমবে। ফলে দেশের মধ্যে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়বে। গত কয়েক বছর ধরেই আমেরিকার জিডিপি রেট ২ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে ভারতের এই রেট ৬ শতাংশেরও বেশি। তাই আমেরিকা ট্যারিফ লাগিয়ে দেশের আর্থিক উন্নতি করতে চাইছে।

চতুর্থত, আমেরিকার বক্তব্য অনুযায়ী, রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনার ফলে সেই টাকা ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাতে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধে অর্থসাহায্য হচ্ছে ভারতের দেওয়া টাকায়। তাই ট্যারিফ লাগিয়ে ভারতকে এক প্রকার সাজা দিতে চাইছে আমেরিকা।

কিন্তু, আসল ঘটনা হচ্ছে, আমেরিকার বদলে রাশিয়া থেকে কম দামে ব্যারেল ব্যারেল তেল কিনছে চীন এবং ভারত। যে কারণে এক প্রকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমেরিকা। তাই রাশিয়ার বাহানা দিয়ে ভারতকে চাপে ফেলতে চাইছে ট্রাম্প।

পঞ্চমত, একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকা থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘এফ-৩৫ লাইটনিং তু’ যুদ্ধ বিমান কেনার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে ভারতকে, কিন্তু, কেনা তো দূর, ভারত এই বিষয়ে আলোচনা করতেই রাজী নন বলে জানিয়েছে ভারত। যার ফলে আমেরিকা সেই রাগ বের করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ষষ্ঠত, আমেরিকার এই ট্যারিফের মূল লক্ষ্যে রয়েছে রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো শক্তিশালী দেশ। এর অন্যতম কারণ BRICS। কারণ, BRICS-এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ নিজেদের কারেন্সি দিয়ে আমদানি-রফতানি শুরু করেছে। অন্যদিকে, ডলারের পরিবর্ত বিকল্প বের করার কথা চাউর হতেই চাপে পড়েছে আমেরিকা। তাই অনেকের মতে, এই ডিডলারাইজেশন আটকাতে এই ট্যারিফ চাপাচ্ছে ট্রাম্প।

BRICS ও ট্যারিফের ওপর India Hood-এর একটি ডিটেল ভিডিও রয়েছে। সেটি দেখার জন্য আপনি আই বাটনে ক্লিক করতে পারেন।

ট্যারিফ নিয়ে ভারতের দাবী কী?

প্রথমত, রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য প্রসঙ্গে, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, রাশিয়ার থেকে তেল কেনা নিয়ে বার বার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভারতকে নিশানা করছে আমেরিকা। কিন্তু অন্যদিকে, এই রাশিয়ার কাছ থেকেই পারমাণবিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনে আমেরিকা। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ শুরুর পরেও সেই আমদানি অব্যাহত।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক বাজারদরের কথা মাথায় রেখে ভারত নিজেদের বাণিজ্যনীতি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, বাজারে কে কত দাম নিচ্ছে, সেই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়া সস্তায় তেল বিক্রি করে বলেই ভারত তা কিনে থাকে।

তৃতীয়ত, ভারত জানিয়েছে, আমেরিকা চায় ভারত কৃষিপণ্য, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার তাদের জন্য পুরোপুরি খুলে দিক। তাতে আমাদের দেশের কৃষকদের ,গোপালক, মৎস্যজীবিদের ক্ষতি, সেটা আমরা চাই না।

ভারতের অ্যাকশন

১। ভারতের ওপর ট্যারিফ চাপানোর পর ভারত এবার চীন ও রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী করতে চলেছে। সেই উদ্দেশ্যে মাসের শেষেই ভারতে আসছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন। অন্যদিকে, এই মাসেই মোদী যেতে পারেন চীন সফরে।

২। ট্যারিফের বিরোধিতায় সারা দেশে মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন রাষ্ট্রবাদী ভারতীয়রা। ম্যাকডোনাল্ডস, কোকা কোলা থেকে আমাজন, অ্যাপলের মতো আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানির দ্রব্য বয়কটের আওয়াজ উঠেছে।

৩। আমেরিকার বোয়িং কোম্পানির সাথে ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল ভারত। তবে ট্রাম্পের শুল্কবাণের পর এবার তা বাতিল করা হয়েছে।

আমেরিকা কি নিজেদের লক্ষ্যে সফল হবে?

একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে আমেরিকার শ্রম চার্জ প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ডলার, অন্যদিকে চিনে সেটা ৪ ডলার, এবং ভিয়েতনামে ১.৮ ডলার। সুতরাং, ট্যারিফ লাগানোর পর আমেরিকায় কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনই জিনিস পত্র তৈরির খরচাও বাড়বে। ফলত, এক প্রকার মূল্যবৃদ্ধি হবে। তাই ট্যারিফ গেমে নিজেরাই ফাঁদে পড়তে পারে আমেরিকা।

আমেরিকার শুল্কবাণ প্রতিহত করতে একসাথে এসেছে ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং চীনের মতো দেশগুলি। আপনার কি মনে হয় এই পরিস্থিতিতে ভারতের এই পদক্ষেপ কি সঠিক?

গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্যJoin Group
চাকরির খবরের জন্যJoin Hood Jobs
রাশিফলের জন্যJoin Hood Rashifal
খেলার খবরের জন্যJoin Whatsapp
সঙ্গে থাকুন ➥