India Hood Decode: দুর্ঘটনা না খুন? প্রকাশ্যে এল যাদবপুরের ১৯ মিনিটের রহস্য

Published on:

Jadavpur University

বাংলার এক বড় বিশ্ব্যবিদ্যালয়, রাত জুড়ে চলছে অনুষ্ঠান, চলছে গান-বাজনা। নেশায় ও আনন্দে মত্ত যুবক-যুবতী। এর মাঝেই হঠাৎ করে ভেসে এল চিৎকার। ঝিলের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল এক অচৈতন্য তরুণীর দেহ। ঝিলের পাশে পড়ে ভাঙা মদের বোতল। কে সেই তরুণী? কী করে মৃত্যু হল তাঁর? দুর্ঘটনা নাকি খুন? কী সেই ১৯ মিনিটের সিসিটিভি রহস্য, যা নিয়ে তোলপাড় গোটা রাজ্য? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য ডিকোড করা হবে এই প্রতিবেদনে।

ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?

দিনটা ২০২৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার। জায়গাটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) ক্যাম্পাস। ঠিক ৪ নম্বর গেটের কাছে ড্রামা ক্লাবের মধ্যে চলছে একটি বড় অনুষ্ঠান। নাটক, গান-বাজনার আনন্দে মত্ত বহু যুবক -যুবতী।

এরপর ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১০টা ২০। হঠাৎ করেই ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত একটি পুকুরে একটি তরুণীর দেহ ভাসতে দেখে কিছু ছাত্র-ছাত্রী। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অবস্থিত KPC হাসপাতালে। সেখানে সেই তরুণীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

কিন্তু, কে এই তরুণী?

এই মৃত তরুণী আর কেউ নয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনামিকা মণ্ডল। বয়স আনুমানিক ২২ বছর। বাড়ি বেলঘড়িয়ার নিমতা এলাকায়। ছোট থেকেই সে মেধাবী ও শান্ত প্রকৃতির। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনও পড়াতেন অনামিকা। বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার দেখাশোনা করতেন। ঘর থেকে কম বেরোতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাতেও ছিল তাঁর প্রবল মনোযোগ।

কিন্তু, ঠিক কী করে মৃত্যু হল তাঁর?

ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবেই। শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবে, ছাত্রীর বাবার কথা অনুযায়ী, “মেয়ের দুই কনুইতে ছড়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে। কেউ হয়তো প্রপোজ করেছিল, ও সাড়া দেয়নি।” আবার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হচ্ছে শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। এখানে এই ফারাক কেন তার উত্তর মেলেনি। অনামিকা সাঁতার জানতো না, তাহলে সে জলের কাছে গেল কেন? সিসিটিভির ফুটেজ অনুযায়ী, সেদিন রাত ১০টা বেজে ১ মিনিটে তাঁকে শেষবার বাথরুমের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল। আর তারপর ১০টা ২০ অবধি তাঁকে আর কোথাও দেখা যায়নি। কিন্তু, সিসিটিভির অভাবে ঘনাচ্ছে প্রায় ১৯ মিনিটের রহস্য।

কিন্তু, কী হয়েছিল ওই ১৯ মিনিটে?

এখন সমস্ত চোখ পুলিশের দিকে। ওই ১৯ মিনিটের জট খুলতে মাঠে নেমে পড়েছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে অনামিকার মোবাইল। জবানবন্দি নেওয়ার জন্য ডাকা হয় ৬ জনকে। এরপর উঠে আসে, সেদিন অনুষ্ঠানে মদ্যপান করেছিল অনেকেই। বসেছিল গাঁজার আসরও। তবে, অনামিকা মদ্যপান করেছিলেন কি না, বা শরীরে অন্য কোনও মাদক পদার্থ ছিল কি না, তার জন্য ভিসেরা পরীক্ষার অপেক্ষা করতে হবে। সহপাঠীদের একাংশের দাবি, হয়তো নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পা টলে ঝিলে গিয়ে পড়ে গিয়েছে অনামিকা। আর এই রহস্য উন্মোচন করতে, পুলিশ এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যার নাম ‘গেট প্যাটার্ন’। এর মাধ্যমে সিসিটিভি ফুটেজে অনামিকার হাঁটার ধরন, অঙ্গভঙ্গি দেখে তাঁর মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু, মৃতার বাবা বলছেন অন্য কথা

তিনি জানিয়েছেন, “টয়েলেটে যাওয়ার আগে যে বান্ধবীর কাছে আমার মেয়ে ব্যাগ রেখে গিয়েছিল, তার ফোন চেক করা উচিত।“ মাদক প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “২২ বছর পর্যন্ত আমার মেয়ে কোনোদিন মাদক সেবন করেনি, তবে ময়নাতদন্তে যদি তার শরীরে মাদক মেলে, তবে তাকে মাদক খাইয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছে কেউ।“ সিসিটিভি ফুটেজ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তিনি কাঠগড়ায় তুলেছেন।

এরপর ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে অনামিকার বাবা যাদবপুর থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, কিছু অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে, ১১ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ১০ মিনিট থেকে ১০টা ২৬ মিনিটের মধ্যে আমার মেয়েকে পুকুরে ঠেলে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে।

এবার এই ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। দু’বছর আগেও এক ছাত্রের মৃত্যুতে উত্তাল হয়েছিল পরিস্থিতি। এই ঘটনার পরেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য আঙুল তোলেন SFI-এর দিকে। তিনি বলেন, “সিসিটিভি লাগানোর বিরুদ্ধে যারা, তারাই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী।“ অন্যদিকে, তৃণমূলের তরফ থেকে প্রশ্ন করা হয়, কেন ক্যাম্পাসের ভিতরে নেই পুলিশ আউটপোস্ট? কেন দীর্ঘ রাত অবধি অনুষ্ঠান চালানোর অনুমতি দিল? কীভাবে কর্তৃপক্ষের নজরদারি পেরিয়ে এত রাত অব্দি ক্যাম্পাসে মদ্যপান সহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ চলে?”

বিজেপি-র তরফ থেকেও এই ঘটনার জন্য SFI-কে দায়ী করা হয়েছে।

এর পাল্টা SFI নেতা সৃজন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এ ধরনের মন্তব্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। যদি সিসিটিভি কারণ হত, তাহলে কসবায় কেন হল? সেখানেও তো সিসিটিভি ছিল। অন্যদিকে ১৬ই সেপ্টেম্বর এই ঘটনার জন্য খানিকটা বিশ্ববিদায়লয়কেই দায়ী করেছে এসএফআই রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে। তিনি সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, যে পুকুরে পড়ে অনামিকার মৃত্যু হয়েছে, তা সংস্কারের অভাবে বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। ওই পুকুর ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা, সংস্কার করার দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি।

কিন্তু, এখানে মনে রাখতে হবে, যাদবপুরে সিসিটিভি নেই বলেই এই ঘটনা নিয়ে এখনও পর্যন্ত রয়েছে ধোঁয়াশা, আদেও দুর্ঘটনা নাকি খুন? সেই নিয়ে চলছে জোর তরজা। অন্যদিকে, কসবায় সিসিটিভি থাকার ফলে অভিযোগ দায়ের হতেই, ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত চার জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।

কিন্তু, রাজনৈতিক তরজায় বারবার কেন উঠে আসে যাদবপুরের নাম?

এর জন্য পিছিয়ে যেতে হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গত কয়েকটি ঘটনা এবং তার পরবর্তী কিছু পরিস্থিতি নিয়ে।

সালটা ২০১৬। সৌমিত্র দে নামের একজন ছাত্র বাঁকুড়া থেকে পড়তে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদায়লয়ে। তারপর হঠাৎ করেই হোস্টেলে নিজের ঘরে সিলিং ফ্যানে গলায় গামছা দিয়ে ঝুলতে দেখা যায় তাঁকে। ছেলে আত্মহত্যা করেনি এমন দাবি তুলে, বিচার চেয়ে কখনও সৌমিত্রর পরিবার ছুটে গিয়েছে যাদবপুরের হস্টেলে, আবার কখনও পুলিশের কাছে। কিন্তু সৌমিত্রর পরিবারের দাবি, তাঁরা আজও সুবিচার পায়নি।

এরপ সালটা ২০২৩। ৯ই আগস্ট রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে প্রথমবর্ষের এক ছাত্র, ১৮ বছর বয়সী স্বপ্নদ্বীপ কুণ্ডু হোস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে মারা যায়। পরিবার সহ সহপাঠীদের অভিযোগ অনুযায়ী, র‍্যাগিং-এর শিকার ছিলেন তিনি। পরে পুলিশ তদন্তে একাধিক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আলোচিত ও অন্ধকারময় অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি। এক্ষেত্রেও সিসিটিভি ফুটেজ না থাকায় পাওয়া যায়নি কোনও তথ্য।

এরপর, নিরাপত্তা এবং নজরদারি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে সিসিটিভি লাগানোর কথা উঠতেই বিরোধিতা করতে শুরু করে পড়ুয়ারা। পরে এই দাবি মেনে নিলেও, অনেকেই ক্যামেরা কোথায় লাগানো হবে, কে নজরদারি চালাবে এই সব জানানোর দাবি তোলে। এমনকি সেই সময়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের একাংশ যুক্তি দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে “নেশা” বা জীবনযাপনের পদ্ধতি ব্যক্তিগত পছন্দ, প্রশাসন এ নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

এমনকি সম্প্রতি এই ঘটনায় যে জলাধার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ছাত্রীর দেহ, সেখানেও প্রমাণ পাওয়া গেল যে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই এখনও ক্যাম্পাসের ভিতরে সিসি ক্যামেরা বসানোর বিরোধী। কারণ, যে পুকুর থেকে ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছে, ঠিক তার সামনেই একটি কাগজে লেখা, ‘পরিকাঠামো শুকিয়ে কাঠ, সিসিটিভি-তে ৬৮ লাখ’। নজরদারি মানেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নয়, তা-ও বোঝানো আছে ওই কাগজে। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় আই-কার্ড এখনও যাচাই করা হয় না বলে দাবি পড়ুয়াদের একাংশের।

এছাড়াও একাধিক সময়ে, বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করলেই দেখা গিয়েছে নানা রকমের সমস্যা এবং ঝামেলা। এখন প্রশ্ন একাধিক, ঠিক কীভাবে মৃত্যু হল ওই তরুণীর? দায়ী কে? রাত অবধি ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠানে ভালো-খারাপ কিছু ঘটলে দায়িত্ব কার? সিসিটিভি না থাকার কারণে এই ঘটনার সমাধান না হলে সে দায় কি তবে বিশ্ববিদায়লয়ের শিক্ষার্থীদেরই? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না আপনাদের মতামত।

গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্যJoin Group
চাকরির খবরের জন্যJoin Hood Jobs
রাশিফলের জন্যJoin Hood Rashifal
খেলার খবরের জন্যJoin Whatsapp
সঙ্গে থাকুন ➥