India Hood Decode: যে অস্ত্রে প্রতি ভোটে বাজিমাত করে প্রশান্ত কিশোর, ফাঁস রহস্য!

Published on:

Prashant Kishor

প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor) ওরফে পিকে – এই নামটা আপনি শোনেন নি এমনটা হতেই পারে না। মোদী হোক বা মমতা, দেশ হোক বা বিদেশ – সব জায়গাতেই জিতে বার বার বাজিমাত করেছেন তিনি। ভারতের একমাত্র কিংমেকার, যার সাকসেস রেটের কাছে মাথা নত করেছেন রাজনীতির বড় বড় মহারথীরাও! অনেকেই তাঁকে বলেন কলিযুগের চাণক্য, যার মুখ এক হলেও মুখোশ একাধিক।

কিন্তু, কোন অস্ত্রে বার বার ভোটে জেতেন তিনি? বিজেপি হোক বা তৃণমূল কিংবা কংগ্রেস – কেন বার বার ছুটে যায় তাঁর কাছে? হঠাৎ কি এমন হল, যে এবার কিং মেকার থেকে কিং হওয়ার দৌড়ে নেমে পড়েছেন তিনি? খুলে ফেলেছেন নিজের দলও। আদৌ কি তিনি জিততে পারবেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর গদি? আজ India Hood ডিকোডে আমরা তুলে ধরবো প্রশান্ত কিশোরের এমন কিছু সত্য, এমন কিছু তথ্য যা আপনাদের মাথা ঘোরাতে বাধ্য করবে।

হঠাৎ দেখা রাহুল গান্ধীর সাথে!

সালটা ১৯৭৭। বিহারের রোহতাস জেলার সাসারাম গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন প্রশান্ত কিশোর। বাবা ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। মা ছিলেন গৃহবধূ। ছোট থেকেই তুখোড় বুদ্ধিমান ছিলেন প্রশান্ত। বক্সারে নিজের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেই, হায়দ্রাবাদে চলে যান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। এরপরেই তিনি চাকরি পেয়ে যান ইউনাইটেড নেশনে একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে। আর এই কাজের জন্য তাঁকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়।

এরপর সালটা ২০০৭। ভারতে এসেই প্রথমে রাহুল গান্ধীর সাথে দেখা করেন তিনি। প্রশান্ত কিশোরের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় রকম পরিবর্তন আনার। কিন্তু রাহুল গান্ধী তাঁর কথায় পাত্তা না দেওয়ায়, একপ্রকার হতাশ হয়েই জাতিসংঘের কাজে ফিরে যান তিনি।

এরপর সালটা ২০১০। আফ্রিকায় কাজ করার সময় প্রশান্তের হাতে আসে ভারতের পিছিয়ে পড়া কিছু রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি স্পেশাল রিপোর্ট। এরপর তিনি নতুন করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অপুষ্টির ওপর একটি ডিটেইলড স্টাডি করেন। প্রশান্ত লক্ষ্য করেন যে ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্য সহ উন্নত রাজ্যগুলিতেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারেই বেহাল

এরপর ২০১১ সালে এই স্টাডির রিপোর্ট, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে পাঠিয়ে দেন প্রশান্ত কিশোর, পাশাপাশি এই রিপোর্টের আর এক কপি পাঠিয়ে দেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও। ব্যাস! এরপরেই বদলে গেল ভাগ্য!

শুরু হল এক নতুন পথ চলার!

এই রিপোর্ট পড়েই প্রশান্ত কিশোরের সাথে যোগাযোগ করেন মোদী। প্রশান্তের সাথে কথোপকথনের পর নিজের দূরদর্শিতা দিয়ে এক অনন্য সিদ্ধান্ত নেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১২ সালে ছিল গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচন, কাছে ছিলেন না সঙ্গী অমিত শাহ। কারণ তখন শোরাবউদ্দিন শেখ মার্ডার কেসে ২০১০ সালে তাঁকে রাজ্য থেকে বাইরের থাকার শর্তে জামিন দিয়েছিল কোর্ট। তাই প্রশান্তকে আসন্ন নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে দেন মোদী। আর সেই থেকেই রাজনীতিতে পথ চলা শুরু হয় প্রশান্ত কিশোরের।

মোদীর বাসভবনের অপরের তলায় খুলে ফেলেন নিজের অফিস। পুরানো ধাঁচ ভেঙে একেবারে নতুন ধাঁচে প্রচার শুরু করেন প্রশান্ত। রাজ্যজুড়ে ভোটের প্রচার করার জন্য প্রথমবার ব্যবহার করা হয় 3D হলোগ্রাম। ফলে গান্ধীনগরে বসেই, গুজরাতের বিভিন্ন জায়গায় ভাষণ দিতে থাকেন মোদী। এই কাজের জন্য MBA, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পলিসি নির্ধারকদের মতো পেশাদারদের নিযুক্ত করেন প্রশান্ত। দলের পুরানো সদস্যরা, আধুনিক ধাঁচের এই প্রচারের বিরোধিতা করলেও, মোদী এই স্টাইলকেই গুরুত্ব দেন। ব্র্যান্ডিং থেকে শুরু করে ভিজ্যুয়াল, শ্লোগান – সবেতেই দেওয়া হয় আধুনিকতার ছোঁয়া। হিন্দুত্ববাদকে সাইড করে, উন্নয়নমূলক কাজকে নিয়ে আসা হয় প্রচারের আলোয়। আর নির্বাচনের ফলাফল আপনারা সবাই জানেন, গুজরাতে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদী। আর ভারত খুঁজে পায় দেশের প্রথম নির্বাচক কৌশলী।

এরপর সালটা ২০১৩। নিজের কাজকে আরও ভালোভাবে করার জন্য প্রশান্ত কিশোর প্রতিষ্ঠা করলেন অ্যাসোসিয়েশন অফ সিটিজেন ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ণেন্স অর্থাৎ CAG। আর এই টিমে IIT, IIMA, AIMS-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বেছে বেছে নিযুক্ত করা হয় ৭০০ জন সদস্যকে। উদ্দেশ্য একটাই – লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর জন্য ভারত জুড়ে প্রচারের বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধান করা।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয়রা 3D হলোগ্রাম তো দেখলোই, পাশপাশি দেখল নির্বাচনের প্রচারে ম্যারাথন দৌড়, মিম থেকে শুরু করে চায়ে পে চর্চার মতো ক্যাম্পেনিং। আর ফল, লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে ক্ষমতায় আসে BJP, দেশের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, এরপর অমিত শাহ আসতেই ঘটল বিপত্তি।

ফাটল PK ও NAMO-র মধ্যে!

ওই বছরেই গুজরাত থেকে দিল্লি পাড়ি দেয় প্রশান্ত। উদ্দেশ্য – দিল্লিতে বসে পলিসি মেকিংয়ের কাজ করা। সেই লক্ষ্যে ২০১৪ সালে CAG ভেঙে প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্ডিয়ান পিপলস অ্যাকশন কমিটি অর্থাৎ IPAC। টার্গেট একটাই – মোদীর সাথে হাত মিলিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করা।

কিন্তু, এর জন্য দরকার ছিল ফ্রিহ্যান্ড, অর্থাৎ যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। আর এমনটাই আশা করেছিলেন প্রশান্ত।

কিন্তু, যেমনটা আমরা আগেই বলেছিলাম বিজেপির বেশ কিছু নেতা তাঁর রীতি-নীতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আর এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন অমিত শাহ

অমিত শাহ মনে করতেন, প্রশান্ত কিশোর একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠছে। তাই এক নতুন প্ল্যান করেন তিনি। ওই বছরই হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচন হলেও, কোনও রাজ্যে কাজ দেওয়া হয়নি প্রশান্ত কিশোরকে। আর পিকে-র সাহায্য ছাড়াই ওই রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় আসে BJP।

ধৈর্যচ্যুত প্রশান্ত মনে করতেন মোদীর এই জয়ের সম্পূর্ণ ক্রেডিট তাঁর পাওয়া উচিত।

উল্টোদিকে BJP-র মনে করত, ২০১৪ সালে মোদীর জয়, নিজেদের দমে পাওয়া জয়, এতে প্রশান্তের অতিরিক্ত কোনও ভূমিকা ছিল না।

ধীরে ধীরে কোণঠাসা হচ্ছেন – এই ভাবনাই কুরে কুরে খেতে থাকে প্রশান্তকে। একবার শেষ চেষ্টা করে মোদী-শাহের সাথে দেখা করেন। কিন্তু, ব্যর্থ হয়ে BJP-র সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন প্রশান্ত।

ঘরে ফেরা

এই সমস্ত কিছুর জন্য, প্রশান্তের ক্ষোভ বাড়তে থেকে অমিত শাহের ওপর। সিদ্ধান্ত নেন বদলা নেওয়ার। আর দেখা করেন তৎকালীন সময়ে মোদী-শাহের অন্যতম বিরোধী মুখ নিতিশ কুমারের সাথে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবার নিতিশ কুমারের সাথে দেখা করেন প্রশান্ত। এরপর, ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য JDU-এর প্রচারের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশান্তকে। কারণ নিতিশ জানতেন, প্রশান্ত BJP-র সমস্ত তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই, নির্বাচনের ময়দানে BJP-র থেকে JDU-কে প্রশান্ত এগিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। ফের নতুন করে কাজ শুরু করে IPAC। নিতিশ কুমারের বাড়িকেই বানিয়ে নেয় নিজের অফিস।

২০১৫ সালে ফের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেশ দেখল নির্বাচনী প্রচারের নয়া কৌশল। ম্যারাথনের জায়গায় রাস্তায় নামল ৫০০০ সাইকেলচায়ে পে চর্চার পরিবর্তে এল পর্চে পে চর্চা। ব্যবহার হল হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের। এই নির্বাচনেই আরও একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেন প্রশান্ত। বিহারে মহাজোট বন্ধনে নীতিশ ও লালু প্রসাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করেন তিনি। ফলাফল দেখা যায় ব্যালট বক্সে। বিহারে বিপুল সিট পেয়ে জয়লাভ করে মহাজোট। আর এটা ছিল প্রশান্তের জন্য যেমন জয়, তেমনই  অমিত শাহের জন্য একটি বড় হার।

হ্যাট্রিক করে প্রশান্ত পেলেন আন্তর্জাতিক ডাক!

কিন্তু, প্রশান্তের সাথে মোদী যে ভুল করেছিল, সেটা নিতিশ করেনি। মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেই প্রশান্তকে ক্যাবিনেট র‍্যাঙ্কের উপদেষ্টার দায়িত্ব দেন নিতিশ। পাশপাশি প্রশান্ত নজর রাখতে শুরু করে বিজেপির সবথেকে বড় বিরোধী দল কংগ্রেসের ওপর। অন্যদিকে, কংগ্রেসও বিহারে প্রশান্তের কাজ দেখে নজর রাখতে শুরু করে তাঁর ওপর।

কিন্তু, পর পর তিনটি নির্বাচনে জেতার পর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেন প্রশান্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বুঝল নির্বাচক কৌশলীর গুরুত্ব। দেখল – চাইলে একজনই পারেন রাজনীতির ময়দানের খেলা ঘোরাতে।

এবার প্রশান্তের কাছে ডাক আসে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকেও। আফ্রিকার তানজনিয়ার রুলিং পার্টি CCM-এর তরফ থেকে নির্বাচক উপদেষ্টার অফার দেওয়া হয় প্রশান্তকে। নিজে না গেলেও, এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি প্রশান্ত। সেখানে I-PAC-এর একটি স্টেশন স্থাপন করেন তিনি। আর পরবর্তী নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভ করে CCM।

এরপর সালটা ২০১৭। টার্গেট পঞ্জাব।

ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং টানা দু’বার পঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে হারার পর এবার মরিয়া হয়ে ডেকে পাঠান প্রশান্ত কিশোরকে। পঞ্জাবের বিধানসভায় চায়ের পরিবর্তে এল কফি, চালু হল কফি উইথ ক্যাপ্টেন ক্যাম্পেন। চলে আরও নানা কৌশল। অমরিন্দর সিংয়ের এই সমস্ত কৌশল ভালো না লাগলেও, ফলাফল সেই একই, পঞ্জাবে বিরাট জয় পায় কংগ্রেস। আর অমরিন্দর সিং রাহুল গান্ধীকে প্রস্তাব দেন উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে পিকে-কে দায়িত্ব দেওয়ার।

এরপর ২০১৭ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয় উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের!

কংগ্রেসের তরফ থেকে দায়িত্ব পেয়েই তড়িঘড়ি কাজ শুরু করে I-Pac। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দেয় প্রশান্ত। কিন্তু, দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিলা দিক্ষীতকে, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসাবে ঘোষণা করে কংগ্রেস।

এরপর প্রশান্ত, কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতির জন্য প্রমোদ তিওয়ারির নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু, হাই কম্যান্ড সভাপতি করে রাজ বব্বরকে।

মোদী হোক বা নীতিশ, আগের প্রত্যেক প্রার্থীর সাথেই দুর্দান্ত মেলবন্ধন ছিল প্রশান্তের। কিন্তু, শীলা দীক্ষিত প্রশান্তের থেকে কিছুটা দূরে করে নেয় নিজেকে। পাশাপাশি, উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের আগে সমাজবাদী পার্টির সাথে জোট করে নেয় কংগ্রেস।

প্রশান্তের কথা মেনে কোনও কাজ না হলেও হাল ছাড়েনি তিনি। চায়ে পে চর্চার মতো এবার নির্বাচনের ক্যাম্পেনে অস্ত্র করেন খাট সভা। যেখানে রাহুল গান্ধী জনসমক্ষে বসে কৃষকদের সাথে তাঁদের অবস্থা নিয়ে চর্চা করতে হবে।

কিন্তু হল হিতে বিপরীত, উত্তর প্রদেশের দেওরিতে প্রথম সভা শেষ হতেই, খাট তুলে নিয়ে যেতে শুরু করে কৃষকরা। ফলে সংবাদের শিরোনামে, খাট সভার থেকে খাট চুরির ঘটনা বেশি আকর্ষণ গ্রহণ করে। যেটা প্রশান্ত আর কংগ্রেস – দুজনের জন্যই ছিল খুবই লজ্জাজনক। এছাড়াও, অখিলেশ আর রাহুলকে নিয়ে ইউপি কে লড়কে-র প্রচার শুরু করে প্রশান্ত। কিন্তু এই প্রথমবার ব্যর্থ হন তিনি। উত্তরপ্রদেশে হেরে ভূত হয় কংগ্রেস। আর বিশাল ব্যবধানে জয় পায় BJP।

শুরু হয় প্রশান্তের সমালোচনা!

অমিত শাহের মতোই এবারে কংগ্রেসেরও একাধিক নেতাও প্রশান্ত কিশোরের বিরোধিতা করতে থাকে।

অনেকে বলতে থাকে, প্রশান্তের নিজস্ব কোনও ভাবধারা নেই। যে টাকা দেয় তার হয়েই কাজ করে।

কেউ কেউ দাবী করেন, নিতীশ, মোদীর মতো ভালো প্রোডাক্ট পেলে তবেই তাদের বেচতে পারে প্রশান্ত, কিন্তু নতুন প্রোডাক্ট এলেই ফেল হয়ে যায় প্রশান্ত।

এই বছরটাই ভালো ছিল না প্রশান্তের। একদিকে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন তাঁর জন্য গলার কাঁটা তো ছিলই, অন্যদিকে মহাজোট ছেড়ে বিজেপির সাথে হাত মেলায় নিতিশ। ফলে, নিতিশের উপদেষ্টার পদ হারায় প্রশান্ত। কিন্তু, সময় বদলাতে বেশি সময় লাগে না।

নির্বাচক কৌশলী হিসাবে অর্জন করেন একের পর এক মাইলফলক!

এরপর সালটা ২০১৮। ৯ সেপ্টেম্বর, ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেসে একাধিক প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। ভাবধারা প্রসঙ্গে জানান, তিনি মূলত পশ্চিমা সেন্টার লেফট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। কিন্তু, কোনও ভাবধারায় অন্ধভক্ত হওয়ার পক্ষপাতী নন।

এরপর তিনি বলেন, এবার নির্বাচন কৌশলীর কাজ ছাড়বেন। কিন্তু, রাজনীতিতে যোগ দেবেন না, কাজ করবেন মাটির মানুষদের সাথে।

কিন্তুর কথার খেলাপ হল ওই মাসেই। ফের নিতিশ কুমারে JDU-তে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে যোগদান করেন প্রশান্ত।

কিন্তু অমিত শাহের ওপর রাগ যে কমেনি প্রশান্তের তার আভাস পাওয়া গেল ২০১৯-এই। মোদী দ্বিতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে, CAA চালু করেন। কিন্তু, JDU-এর জোট সঙ্গী BJP হওয়া সত্ত্বেও খোলাখুলি CAA বিরোধিতা করতে থাকে প্রশান্ত। নীতিশের হাজার বারণ করলেও পাত্তা দেন না তিনি, ফলে বাড়ে দূরত্ব।

এরই মাঝে অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াই এস জগন রেড্ডি, এবং মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরের জয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন পিকে।

এরপর সালটা ২০২০। বছরের শুরুতেই নিজের দল থেকে ফের প্রশান্তকে বের করে দেয় নীতিশ। কিন্তু, প্রশান্ত কোনদিনও নীতিশের বিরোধিতা করেননি। উল্টে তিনি জানান, নীতিশ তাঁর কাছে বাবার মতো, আর এতদিন সে তাঁকে নিজের ছেলের মতো রেখেছিল, তাই এই নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করবো না।

এরপর ওই বছরেই কংগ্রেসের সাথে আবার যোগাযোগ করে প্রশান্ত, জানায়, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করে তাঁর কাছে একটি প্ল্যান আছে। কিন্তু, কংগ্রেস তাঁকে “না” বলে দেয়। তবে, ওই বছরই দিল্লিতে কাজ শুরু করে IPAC, আর জয় পায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

এরপর সালটা ২০২১। পশ্চিমবঙ্গে ভরাডুবি থেকে বাঁচতে IPAC-এর সাথে হাত মেলায় তৃণমূল। হয় কয়েক কোটি টাকার ডিল। দিদিকে জেতাতে ফের মাস্টারপ্ল্যান করে প্রশান্ত। BJP-কে বহিরাগত প্রমাণ করতে, সারা বাংলা জুড়ে চালানো হয় – বাংলা নিজের মেয়েকে চায় ক্যাম্পেন। চলে দুয়ারে সরকার, পাড়ায় পাড়ায় সমাধানের জনপ্রিয় ক্যাম্পেন। মানুষের সমস্যা দ্রুত মেটাতে চালু করেন দিদিকে বলো ক্যাম্পেন। বাংলার প্রতিটি যুবককে হাতিয়ার করে শুরু হয় “দিদির দূত” ক্যাম্পেন।

এমনকি নির্বাচনের ৪-৫ মাস আগেই, প্রচার করতে করতে প্রশান্ত টুইট করে জানিয়ে দেন, “মিডিয়া যাই বলুক, বিজেপি দুই সংখ্যার বেশি অতিক্রম করতে পারবে না। আর যদি করে আমি এই কাজ ছেড়ে দেবো।“ প্রশান্তের আত্মবিশ্বাস সত্যি হয়, বিজেপি ৭৭টির বেশি আসন লাভ করেনি, বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল।

এরপর ওই বছরেই তামিলনাড়ুতে এমকে স্ট্যালিনের জয়ের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করেন প্রশান্ত। পাশাপাশি, ওই বছর পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের মুখ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেও সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।

কংগ্রেসে যোগদানের ডাক পায় প্রশান্ত!

এর মাঝেই কংগ্রেসের সাথে একাধিক ছোট-খাটো মিটিং হলেও, পিকে-র সাথে হাত মেলানোর কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি কংগ্রেস। তবে, হাল ছাড়েনি প্রশান্তও। কংগ্রেসকে আগাগোড়া ঢেলে সাজাতে তৈরি করেন ব্লু প্রিন্ট। আর ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে, কংগ্রেসের সাথে শেষ একটি মিটিং করেন প্রশান্ত। দলের পুনর্গঠনের জন্য পার্টির মধ্যেই নির্বাচন, নীচু তলার অনুগতদের দলে গুরুত্ব দেওয়া, ব্যাপক হারে কংগ্রেস দলের সদস্য বাড়ানোর কথা বলেন তিনি। অন্যদিকে, গান্ধী পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ কিন্তু অকেজো ব্যাক্তিদের বাদ দেওয়ার প্রস্তাবও দেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিজেপি ও হিন্দু বিরোধী ন্যারেটিভ প্রচার করার রোডম্যাপ তৈরি করেন।

ওই মিটিংয়ে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং কংগ্রেস দলের পুনর্গঠন নিয়ে মোট ২১টি পয়েন্ট বলে প্রশান্ত, যার মধ্যে ১৮টিতে সম্মত হয় কংগ্রেস। কিন্তু, পিকে-র পরামর্শ না মেনে উল্টে তাঁকে কংগ্রেসে যোগদান দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা নাকচ করেন তিনি।

এসবের মাঝেই, প্রশান্তের একটি কন্ট্রোভার্সিয়াল অডিও সামনে আসে, যেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “BJP হারুক বা জিতুক, আগামী কয়েক দশক দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে BJP-ই থাকবে। যেমন ভাবে স্বাধীনতার পর ৪০ বছর কংগ্রেস ছিল। ভাববেন না যে লোক মোদীকে বের করে দেবে, যদি মোদীকে বের করেও দেয়, BJP কোথাও যাচ্ছে না। রাহুল গান্ধী যেটা মনে করছে, সেটা কখনোই হবে না।“

রাজনীতিতে পদার্পণ প্রশান্তের!

এরপর হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে বিহারের রাস্তায় নামেন তিনি। ছেড়ে দেন নির্বাচন কৌশলীর কাজও। নীচু তলার মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে ২০২২ সালের মে মাসে প্রশান্ত শুরু করেন জন সুরাজ যাত্রা। তিনি এই যাত্রায় ৬৬৫ দিন পায়ে হেঁটে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিমির বেশি পথ হাঁটেন। ভ্রমণ করেন বিহারের প্রায় এক হাজার গ্রাম। কথা বলেন গ্রামের উন্নতি নিয়ে, উন্নত জীবনযাপন নিয়ে।

কিন্তু, তাঁর এই কাজের জন্য অনেকেই তাঁর ফান্ডের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন।

তবে, এই সবকিছু উপেক্ষা করে ২০২৪ সালের ২রা অক্টোবর জন সুরাজকে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে স্বীকৃতি দেয় প্রশান্ত। দলের লোগো হয় স্কুল ব্যাগ

পাশাপাশি প্রশান্ত ঘোষণা করেন, তিনি কারোর সাথে জোট সরকার গড়বেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সরকার গড়বেন না। এবং ক্ষমতায় এলে এক ঘণ্টার মধ্যে সারা রাজ্যে মদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেবেন।

এতদিন নির্বাচন কৌশলী হিসাবে নির্বাচনের ময়দানে একাই রাজ করতেন প্রশান্ত, কিন্তু, রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি কতটা সফল হবেন? উত্তর এসে গেল ওই বছরের শেষেই। ২০২৪ সালের শেষের দিকে, বিহারের ৪টি আসনে বাই-ইলেকশন হয়। সেখানের ৪টি সিটেই প্রার্থী দেয় প্রশান্ত। আর ৪টি সিটেই গো-হারান হারে তারা।

অন্যদিকে, ২০২৪ সালে অন্ধপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ফের ওয়াই এস জগন রেড্ডিকে ক্ষমতায় আনতে কাজ করে IPAC। আর, লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে TMC-কে সাহায্য করে বিরাট ব্যবধানে জিততে। তবে, ২০২৫ সালে দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাজ করলেও জয় পায়নি AAP।

এবার প্রশান্ত কিশোরের টার্গেট ২০২৫-এর বিহারের বিধানসভা নির্বাচন! মক টেস্টে ফেল করলেও, পিছু হঠেনি প্রশান্ত। গত ১২ বছরে, তিনি ১০ বার জিতিয়েছেন অন্যদের। এতদিন যিনি রাজা তৈরি করতেন, এবার তিনি কি হতে পারবেন বিহারের পরবর্তী রাজা? আপনার কী মতামত? জানাতে ভুলবেন না কমেন্টবক্সে।

 

গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্যJoin Group
চাকরির খবরের জন্যJoin Hood Jobs
রাশিফলের জন্যJoin Hood Rashifal
খেলার খবরের জন্যJoin Whatsapp
সঙ্গে থাকুন ➥