বিক্রম ব্যানার্জী, কলকাতা: নেপালের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি গোটা দক্ষিণ এশিয়া বলা ভাল, সমগ্র বিশ্বকে ভাবিয়েছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটির ছাত্র যুবদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় শিবপুরি ব্যারাকে ঠাঁই হয়েছে নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির। এদিকে, পরিস্থিতি ক্রমশ বেগতিক দেখে GenZ-র অনুরোধ মেনে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেপালের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছেন দেশটির প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। তবে শপথ গ্রহণের আগে এবং পরে, উভয় পরিস্থিতিতেই ভারতের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন তিনি। সেই সাথে, নেপালের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। ঠিক এই আবহেই প্রশ্ন উঠছে, ভারতের জন্য কেন এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই নেপাল রাষ্ট্র।
ভারতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ নেপাল?
প্রথমেই বলে রাখি, 3 কোটির কিছুটা বেশি জনসংখ্যার নেপাল আদতে ভারত এবং চিনের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে। নবভারত টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় 35 লক্ষ নেপালি এদেশে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত। শুধু তাই নয়, নেপালের গোর্খা জনগোষ্ঠীর 32,000 সদস্য বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি, হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে নেপালের সাথে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গভীর সম্পর্ক (India-Nepal Relations) রয়েছে। উভয় দেশের নাগরিকরাই পাসপোর্ট বা ভিজা ছাড়াই একে অপরের দেশে যাতায়াত করতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, পড়শি নেপাল হিন্দু তীর্থস্থান হওয়ার সুবাদে প্রতিবছর ভারত থেকে হাজার হাজার হিন্দু শরণার্থী ঘুরতে যান সে দেশে। তাছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকে নানা ভাবে ভারতের সাহায্য নিয়েই চলছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটি।
নেপালের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত
বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, নেপালের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার কিন্তু ভারত। গত আর্থিক বছরে ভারত পড়শি দেশটিতে 7.32 বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে, নেপাল থেকে এদেশে আমদানি করা হয়েছে 1.2 বিলিয়ন ডলারের পণ্য। কাজেই বলাই যায়, সার্বিক দিক থেকেই নয়া দিল্লির উপর নির্ভরশীল কাঠমান্ডু। শুধু তাই নয়, নেপালকে সবচেয়ে পছন্দের জাতির মর্যাদা দিয়েছে ভারত। মূলত সে কারণেই দুই দেশই একে অপরের বেশিরভাগ পণ্যের উপর কোনও রকম কর আরোপ করে না। বলে রাখি, ভারত থেকে নেপালে রপ্তানি হওয়া প্রধান পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে পেট্রোলিয়াম পণ্য, যানবাহন, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ এবং খাদ্য সামগ্রী। অনেকেই হয়তো জানেন, নেপালের মোট বাণিজ্যের 60 শতাংশেরও বড় অংশের অংশীদার ভারত।
এদিকে, বন্ধু রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ তেলও আমদানি করে নেপাল। মূলত ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের হাত ধরে পড়শি দেশে পৌঁছে যায় তেল এবং তৈল পণ্য। তেলের পাশাপাশি সাশ্রয়ী মূল্যে নেপালে বিদ্যুতও পৌঁছে দেয় ভারত। একইভাবে নেপাল থেকেও বেশকিছু পণ্য আমদানি হয় এদেশে। যে গুলির মধ্যে রয়েছে, পাটজাত পণ্য, ইস্পাত, ফাইবার, কাঠের আসবাব, কফি, চা এবং বেশ কিছু প্রয়োজনীয় মশলা। এছাড়াও গতবছর নেপাল থেকে সবচেয়ে বেশি ভেজিটেবল অয়েল ও চর্বি আমদানি করেছিল ভারত। বলে রাখা ভাল, নেপালে ভারতীয় সংস্থার একাধিক প্রকল্প চালু রয়েছে। যার হাত ধরে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বহু মানুষের। সব মিলিয়ে, ভারতের উপর যেমন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল নেপাল, ঠিক তেমনই ভারতও নেপালের দ্বারা উপকৃত। ফলে, দু’দেশের কাছেই একে অপরের গুরুত্ব অপরিসীম।
অবশ্যই পড়ুন: দেশেই তৈরি হবে ১১৪টি রাফাল যুদ্ধবিমান, ২ লক্ষ কোটি খরচ করে ইতিহাস তৈরির পথে ভারত!
বাণিজ্য বন্ধ হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে?
বিগত দিনগুলিতে নেপালের পরিস্থিতি যেভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়েছিল ভারতীয়দের। তবে বর্তমানে সে দেশে পরিস্থিতি শিথিল হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির দায়িত্ব নিয়েছেন সুশীলা। ফলে ধীরে ধীরে আবারও পুরনো ছন্দে ফিরছে নেপাল। যদিও এরই মাঝে প্রশ্ন উঠছে, কোনও ভাবে নেপালের সাথে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে কতটা ক্ষতি হবে ভারতের? এ প্রসঙ্গে এক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। ভারত সরকার এখনও গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। যে কোনও ধরনের সমস্যা সমাধানের স্বার্থে রপ্তানি প্রচার কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, মসৃণ বাণিজ্য প্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নেপালের সাথে কয়েক দশকের পুরনো বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব বজায় রাখার জন্য উভয় দেশের অফিসিয়ালরা আলোচনায় বসুক। যদিও তিনি মনে করছেন, দু দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ছেদ পড়লে আদতে ক্ষতি হবে নেপালেরই। এদিকে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের সহ প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তবা জানিয়ে দিয়েছেন, পরিবহন রুট, কাস্টমস অপারেশন বা আন্ত সীমান্ত সরবরাহে যে কোনও ধরনের বাধা দুই দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যা ভারতীয় রপ্তানিকারক এবং নেপালের উপভোক্তা উভয়কেই প্রভাবিত করবে। যদিও বিশ্লেষক মহলের দাবি, নেপালের সাথে সম্পর্ক যাতে খারাপ খাতে না বয়ে যায় সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে নয়া দিল্লি। তাছাড়াও, দেশটির বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের নিবিড় যোগ রয়েছে। কাজেই, তিনিও চাইবেন দু’দেশের সম্পর্ক যেন সুস্থ থাকে।