ড.শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া (Bhai Phota 2025) আসলে এক চিরন্তন বন্ধন। ব্রাহ্ম মুহূর্তে স্নান সেরে ফোঁটা দেওয়া – শুধু দীর্ঘ জীবন কামনা নয়, এক পবিত্র সম্পর্কের অঙ্গীকার বহন। এই উদযাপনের নানা নাম। নানা চেহারা। কোথাও এর নাম ‘ভাইদুজ’, কোথাও ‘ভাইটিকা’, কোথাও বা ‘ভাইদুতিয়া’। তবে নাম যাই হোক – এর উদযাপনের চরিত্রে সর্বত্রই জড়িয়ে ভাই-বোনের পবিত্র বন্ধন।
বাংলার ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়াতে বোন বা দিদিরা তাঁদের বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে টিকা দেন। স্থান এবং পরিবারভেদে কোথাও ফোঁটা দেওয়া হয় আবিরে, কোথাও আবার শিশিরে। কোথাও কোথাও আবার চল চন্দন কিংবা ঘি অথবা দই দিয়ে ফোঁটা পরানোর। ফোঁটা দেওয়ার পর ভাই অথবা দাদাকে মিষ্টি খাওয়ানোর রেওয়াজ সর্বত্র। তবে কোথাও কোথাও নিম পাতা খাওয়ানোরও রেওয়াজ আছে। কিন্তু নিম পাতা কেন? লোকবিশ্বাস – নিম পাতা খাওয়ালে ভাই বা দাদার সমস্ত বিপদ কেটে যায়। কিন্তু আমার পিতামহ পণ্ডিতপ্রবর সন্তোষ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন – এই নিয়মের সঙ্গে সংযুক্ত অশ্বিনী কুমারদ্বয়। দ্বিতীয়াতেই জন্মেছিলেন তাঁরা। তাঁদের ব্রত করার নিয়মও ছিল দ্বিতীয়াতেই। আবার এই অশ্বিনীকুমারদ্বয় ছিলেন স্বর্গের বৈদ্য। কাজেই নিম পাতার সঙ্গে সম্পর্কটুকু সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।
একসময় এই ভাইফোঁটায় দাদা বা ভাইকে যে আসনে বসতে দেওয়া হতো এই আসনের নকশা নিজের হাতে বুনতেন বোন বা দিদিরা। প্রতিবছর তৈরি করা হতো নতুন আসন। সেই প্রথা আজ অবশ্য তেমন চোখে পড়ে না। তবে ভাইফোঁটা উপলক্ষে থালা সাজানোর নিয়ম এখনও তার অতীতের শিকড়টুকু রেখে দিয়েছে। থালায় আজও থাকে প্রদীপ, শঙ্খ, ধান, দূর্বা ইত্যাদি। সঙ্গে ফোঁটা দেওয়ার উপাদান হিসেবে কোথাও চন্দন, কোথাও দই, কোথাও বা ঘি।
ভাইফোঁটার সময় দাদা বা ভাইকে উত্তর বা পূর্ব দিকে মুখ করিয়ে বসানো হয়। কোথাও কোথাও কোথাও আবার সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে ফোঁটা দেওয়া হয়। অনেক পরিবারেই ভাইফোঁটা দেওয়ার ক্ষেত্রে বারদোষ দেখার নিয়ম আছে। ভাই ফোঁটা শনি বা মঙ্গলবারে পড়লে সেখানে ফোঁটা দেওয়া হয় না। সেখানে থাকে আশীর্বাদ দেওয়া, খাওয়া দাওয়া পর্ব আর উপহার বিনিময়।
প্রতিপদে ফোঁটা আর দ্বিতীয়াতে ফোঁটার নিয়ম মূলত এক। তবে ছড়া বদলে যায়। প্রতিপদের প্রচলিত ছড়া হলো –
“প্রতিপদে ফোঁটা দ্বিতীয়াতে নীতা, আজ হতে ভাই আমার যম দুয়ারে তিতা।”
আর দ্বিতীয়াতে ফোঁটা হলে উচ্চারিত হয় –
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।”
ভাই বা দাদা কাছে না থাকলে দেওয়ালেতে ফোঁটা দেওয়ারও প্রথা আছে।
কিন্তু কীভাবে শুরু হলো এই উৎসবের? সে বিষয়ে রয়েছে একাধিক প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনি।
এই কাহিনিগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত যম এবং যমুনার কাহিনি। ভাইফোঁটার ছড়ার সঙ্গেও এই কাহিনিরই যোগ। এই কাহিনি অনুসারে, সূর্যদেবের সন্তান যমুনা ও যমের মধ্যে ছেলেবেলায় বিচ্ছেদ ঘটে। যমুনার স্বামীর বাড়িতে একদিন যম হঠাৎই চলে আসেন। যমুনার আতিথেয়তা পেয়ে যম ভীষণ খুশি হয়ে যমুনাকে বর চাইতে বলেন। যমুনা তখন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালনের কথা বলেন। যমুনা বলেন – এই তিথি পালন করলে যেন ভাই বা দাদারা দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। যম তাতে সম্মতি জানান।
অন্য আরেকটি কাহিনিতে আছে দেবী লক্ষ্মী এবং রাজা বলির কথা। একবার ভগবান বিষ্ণু বলির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বলিকে বর দিতে চান। বলি প্রার্থনা করেন – ভগবান বিষ্ণু যেন পাতাল লোকের দ্বার পালক হন। ভগবান বিষ্ণু তাতেই সম্মত হন। দেবী লক্ষ্মী তখন ভগবান বিষ্ণুকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায় রাজা বলিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এরপর দেবী লক্ষ্মীর প্রার্থনায় রাজা বলি ভগবান বিষ্ণুকে দ্বার পালকের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেন। অনেকে বলেন সেই সময় থেকেই ভাইফোঁটা উৎসব শুরু হয়।
এই ভাইফোঁটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষ্ণ-সুভদ্রার আখ্যানও। কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে নরকাসুরকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলে তাঁর কপালে বিজয় তিলক এঁকে দেন সুভদ্রা। অনেকে বলেন সেই থেকেই এই ভাইফোঁটা উৎসবের সূচনা হয়।
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া- অবশ্য পালনীয় হিসেবেই বিবেচিত হয়। কারণ বিশ্বাস করা হয় ভাই বা দাদা থাকতেও যাঁরা ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন করেন না – তাঁদের সাত জন্ম ভ্রাতৃহীন থাকতে হয়।
এই দিন যম, চিত্রগুপ্ত এবং যমদূতের পুজোর শাস্ত্রীয় বিধান আছে। ভ্রাতা ও ভগিনী – উভয়ের জন্যই আছে পূজা এবং অর্ঘ্য দানের বিধান। দাদা বা ভাইকে ভোজন করানোর শাস্ত্রীয় মন্ত্রও আছে। তবে তার অবশেষ চোখে পড়ে না। কারণ ভাইফোঁটা উপলক্ষে বাংলায় সর্বত্রই উচ্চারিত হয় বাংলা ভাষায় লেখা প্রতিপদ ও দ্বিতীয়া ভেদে দুটি ছড়া।