ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: *ছিলেন বলুহাটি ব্ৰাহ্মসমাজের আচার্য। ব্রাহ্মসমাজের প্রচার এবং প্রসারে একসময় অংশগ্রহণও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজীদের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে পৈতে ত্যাগের নির্দেশ এলে পৈতে ত্যাগে রাজি হলেন না নগেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মসমাজের সংশ্রব ত্যাগ করে এই নগেন্দ্রনাথই পরবর্তীকালে হয়ে উঠলে সনাতন ধর্মের প্রচারক – পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ। তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ। এই সুরেন্দ্রনাথের পুত্ররাই বাংলা সংগীত জগতের তিন কিংবদন্তি – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, স্বর্ণ কণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। আজও বাঙালির দীপান্বিতা উৎসবের আবাহন হয় তাঁদের গানেই। এঁদেরই পরিবারের কালী আরাধনার ব্যতিক্রমী ধারার কথা শোনালেন সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের দৌহিত্র ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।*

স্বগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন, কলকাতায় পেট্রিয়টিক ইনস্টিটিউশন নামে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করা, ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য বাংলা পদ্যে ‘প্রতিজ্ঞা শতক’ রচনা – এইসবের মধ্যেই একসময় ব্যস্ত ছিলেন ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দী, আরবি, ফার্সি, ল্যাতিন, গ্ৰীক প্রভৃতি আটটি ভাষার নিষ্ণাত পণ্ডিত নগেন্দ্রনাথ। কর্মরত ছিলেন প্ৰথমে জনাই ইংরেজি বিদ্যালয়ে, পরে বালি ইংলিশ হাই স্কুলে প্রধান-শিক্ষকের পদে। বালি ইংলিশ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীনই ১৮৮১ সালে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নগেন্দ্রনাথের। এর পরবর্তী জীবন নিরবচ্ছিন্ন সাধনার।
কাশীর সুমেরু মঠাধীশ শংকরাচার্য প্রমুখ ধর্মপ্রচারকরা তাঁকে ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁকে তাঁরা স্বীকার করে নেন পরমহংস হিসেবেও।
পরমহংস যোগানন্দ এই মহান যোগীকে পরম শ্রদ্ধায় অভিহিত করেছেন “ভাদুড়ী মহাশয়” হিসেবে। পরমহংস যোগানন্দের লিখিত পৃথিবী বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Autobiography of a Yogi’-র সপ্তম অধ্যায় ‘The Levitating Saint” – এই মহান যোগী নগেন্দ্রনাথেরই দিব্য জীবনের বর্ণনা। সনন্দলাল ঘোষের লিখিত গ্রন্থ ‘Mejda’-তেও লঘিমাসিদ্ধ যোগী হিসেবে তাঁর শূন্যে ভেসে থাকার অলৌকিক ক্ষমতার বর্ণনা আছে।
এই পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল হাওড়ার পায়রাটুঙ্গির এক বিত্তশালী জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল পার্বতীচরণ ভাদুড়ী। এঁরা ছিলেন কাশ্যপ গোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। এই ভাদুড়ী বংশেরই মহান সন্তান ছিলেন উদয়নাচার্য ভাদুড়ী।
এই ভাদুড়ী পরিবার ছিল অর্থে আর বিদ্যায় একই সাথে দেবী লক্ষ্মী এবং দেবী সরস্বতীর কৃপাধন্য। ছন্দ, ব্যাকরণ, স্মৃতি সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে এঁদের যেমন ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য তেমনই ছিল প্রগাঢ় ভক্তি।
এই পরিবারে ছিল শাস্ত্র পাঠ, শালগ্রাম – বাণলিঙ্গের নিত্য পুজো। বিশেষ বিশেষ পুজোর ক্ষেত্রে পুজোর দায়িত্ব পালন করতেন সাঁতরাগাছির কুল -পুরোহিতরা। তা সে চণ্ডী পুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো – যাইহোক। এই পরিবারে পুজোতে মানা হতো তন্ত্রোক্ত বিধি। যদিও এই পরিবারের বৈষ্ণব প্রীতি ছিল বিলক্ষণ। তাই এই পরিবারের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল হরিনাম সংকীর্তন পর্বও। কারণ কলিযুগে তো হরি নামেই সব -“কলৌ তদ্ধরিকীর্তনাৎ।”
এই পরিবারে কালী পুজো হতো জমিদারির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সেখানেই হতো পুজো, অর্চনা। তাতে অংশ নিতেন পরিবারের সবাই। বাড়ির গৃহবধূ এবং কন্যাদের জন্য থাকতো সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা। পুজো দেওয়া থেকে পুজো দেখা – সবকিছুতেই। এই পরিবারের পূর্ব পুরুষরা একসময় নদিয়ার নবদ্বীপে ছিলেন। তাঁরা এসেছিলেন রাজশাহী থেকে পাঁচশ বছর বা তারও কিছু সময় আগে। নবদ্বীপে থাকার সময় এঁরা তন্ত্রসাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। নিত্য মা কালীর পুজোও হতো। তবে সেটা যন্ত্রে। নিত্য কালীপুজোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো পায়রাটুঙ্গিতেও নিজস্ব পুঁথি। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মা কালীর পুজো হতো প্রাচীন পুঁথি মেনে। তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে। এর সঙ্গে যেসব গুপ্ত বিষয় সংযুক্ত ছিল – তার ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করতেন কুল পুরোহিতরা।
দেবীকে যে অন্নাদি প্রদান করা হতো তা প্রস্তুত করতেন বাড়ির পুরুষরা – উপনয়ন পরবর্তী পর্বের পর। আর দেবীকে যেসব মিষ্টান্ন দেওয়া হতো – সেগুলি সবই তৈরি করতেন ভাদুড়ী পরিবারের গৃহলক্ষ্মীরা।
মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ছিলেন যোগমার্গের একজন সিদ্ধ সাধক। বাল্যকালেই তিনি হঠযোগ এবং রাজযোগের প্রাণায়ামাদিতে সিদ্ধি লাভ করেন। সাধন পরবর্তী জীবনে প্রতিমুহূর্তে তাঁর মধ্যে নানা সাত্ত্বিক লক্ষণ প্রকাশিত হতো।
যোগ মার্গের সিদ্ধসাধক হিসেবে নগেন্দ্রনাথ পরবর্তী জীবনে মা কালীকে উপলব্ধি করেছিলেন অন্যভাবে। ছয় চক্রের প্রত্যেক চক্রে স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ মহাদেব এবং কুণ্ডলী দেবীর চক্রে চক্রে দেবাদিদেবকে বেষ্টনই তখন সত্য। প্রত্যেক চক্রে দেবীকে নিয়ে যাওয়াই সাধনা। আসলে, যেখানে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ক্রিয়া করেন – শিবশক্তি সমন্বিত তিনিই তো সাধকের ইষ্ট দেবী :
” শুন্যরূপং শিবং সাক্ষাদিন্দুং পরমকুণ্ডলীম্।
সার্দ্ধত্রিবলয়াকার কোটিবিদ্যুৎসমপ্রভা।।”
অনুরূপভাবেই গুপ্ত সাধনা করতেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র ননীলাল ভাদুড়ী – মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের মানসপুত্র ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী।
এই ভাদুড়ী পরিবারেরই কেউ স্মৃতি শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে বর্ধমান মহারাজের কাছ থেকে ভট্টাচার্য উপাধি পান। তাই এই পরিবারের অনেকেই ভট্টাচার্য ব্যবহার করতেন। এই ভাদুড়ী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই মনোমালিন্যের কারণে পূর্বপুরুষের বংশানুক্রমিক সম্পত্তি তো বটেই, একসময় জমিদারির অধিকারও ছেড়ে দেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। একসময় সন্ন্যাস নিতে চাইলেও গুরু পরিবারের নির্দেশে তিনি বিবাহ করেন অন্নপূর্ণা দেবীকে। বিএনআর-এ চাকরি নেন সুরেন্দ্রনাথ। এই সুরেন্দ্রনাথ এবং অন্নপূর্ণা দেবীরই তিন সন্তান – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, স্বর্ণকণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধকশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য।
সুরেন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণের পর হাওড়ার বালিতে পারিবারিক গৃহ দেবতা বাণলিঙ্গের পুজোর ভার গ্রহণ করেন পরিবারের বড়ো ছেলে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য। তিনি আজীবন বাণলিঙ্গ শিবেরই আরাধনা করে গেছেন। আগের দিনের সংযমের পর কালী পুজোর দিনগুলোতে তিনি নির্জলা উপবাস পালন করতেন। নিত্য কালীপুজো তিনি করতেন। তবে কালীপুজোর দিন তিনি দশোপচারে মায়ের আরাধনা করতেন। তাঁর অনুচ্চ স্বরে মন্ত্র উচ্চারণে সেই আরাধনা পেতো এক অন্য মাত্রা।
বাংলা সংগীত ধারার চিরকালীন কিংবদন্তি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যও কালীপুজের আগের দিন সংযম করতেন। পুজোর দিন নির্জলা উপোস করতেন। বাড়ির পুজো নিজেই করতেন। মাকে দিতেন এক সের রাবড়ি। সেই মাতৃ আরাধনার সময় তাঁর সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তো এক স্বর্গীয় আলো।
সাধকশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য বড়ো হয়েছিলেন দুই দাদার প্রধানত বৈধী ভক্তির ধারা দেখতে দেখতে। পরবর্তীকালে তিনি নিজে বালি বারেন্দ্রপাড়ায় নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মায়ের প্রতিমা। সেখানে তিনি নিত্য পুজো করতেন মা দক্ষিণাকালীর। পরে অবশ্য তিনি ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন মানস পুজোয়। গঙ্গার ঘাটে, শ্মশানে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে তাঁর অন্তর্যাগ। সঙ্গে গোপনে চলতে থাকে শ্মশান সাধনা।
জীবনের শেষ পর্বে তিনি হয়ে ওঠেন সংসারে সন্ন্যাসী। তিন কন্যা সন্তানের এই পিতার কাছে তখন সর্বস্ব – পরম পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির পদপ্রান্তে বসে ভক্তি ভিক্ষা আর মায়ের নাম। লোকের আড়ালে মুখে আর লোকের সামনে অন্তরে। মা ভবতারিণীর দর্শন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সে এক আশ্চর্য আকুতি।