সৌভিক মুখার্জী, কলকাতা: গত এক দশকে সোনার দাম এত ঊর্ধ্বগতি কেউ দেখেনি। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শুল্কযুদ্ধ আর ডলারের দুর্বলতার কারণে একেবারে ঝলকানি দিচ্ছে হলুদ ধাতু। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানেই প্রায় ৫০ হাজার টাকা ঊর্ধ্বগতি হলুদ ধাতুর বাজার দর (Gold Price)। এক লাগাড়ে হু হু করে বাড়ছে সোনার দাম। ফলে বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রেতাদের কপালে শুধু চিন্তার ভাঁজ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
তবে সবথেকে বড় ব্যাপার, বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ বলছে, খুব শীঘ্রই সোনার দাম প্রতি ১০ গ্রামে ২ লক্ষ টাকার গণ্ডি পেরোবে। তবে প্রশ্ন উঠছে, কেন এমনটা হচ্ছে? কী কারণে এতটা ঊর্ধ্বগতি হলুদ ধাতুর বাজার দর? এই প্রতিবেদনে এমনই ১৫টি বড় বড় কারণ তুলে ধরব, যেগুলি সোনার দামকে ঊর্ধগতিতে নিয়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির সোনা মজুদ
বিশ্বের বড় বড় দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি প্রচুর পরিমাণে সোনা কিনে থাকে। যেমন ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, চিনের পিপলস ব্যাঙ্ক। তারা তাদের রিজার্ভে বিপুল পরিমাণে সোনা রেখে দিয়েছে। আর এই চাহিদার জন্যই বাজারে সোনার দাম ঊর্ধ্বগতি।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন সংঘাত, এইসব কিছু বিনিয়োগকারীদেরকে আতঙ্কিত করে তুলছে। আর ইতিহাস বলছে, যুদ্ধকালীন সময়ে সোনা সবথেকে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প। তাই সোনার দাম ঊর্ধ্বগতি।
ডি-ডলারাইজেশন
বিশ্বজুড়ে দিনের পর দিন ডলারের আধিপত্য কমছে। রাশিয়া, চিন কিংবা ভারত, একাধিক দেশ নিজেদের মধ্যে এবার বাণিজ্য করতে শুরু করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ায় সোনার দিকে ঝুঁকছে সবাই, যার কারণে সোনার বাজার ঊর্ধ্বগতি।
সীমিত সরবরাহ
স্বর্ণ খনির সংখ্যা, উৎপাদন, কয়েক বছর ধরে অনেকটাই কমেছে। এমনকি নতুন খনিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলত বাজারে সরবরাহ কম হওয়ায় দাম হু হু করে বাড়ছে।
মুদ্রার অবমূল্যায়ন
বর্তমানে অনেক দেশের মুদ্রার মান তলানিতে ঠেকেছে। বিশেষ করে ডলারের তুলনায়। আর মুদ্রার এই দুর্বলতার কারণেই মানুষ তাদের সম্পদের মূল্য রক্ষা করার জন্য সোনার দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
চিনে সোনার চাহিদা
চিন সবথেকে বেশি সোনা আমদানি করে থাকে। আর সম্প্রতি চিনের বিনিয়োগ বাজার দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মানুষ ব্যাঙ্কের বদলে সোনাকে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে ভাবছে।
ক্রিপ্টো এবং শেয়ারবাজারে দুর্বলতা
বিটকয়েন কিংবা স্টক মার্কেটের অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের ভরসা দিনের মধ্যে নষ্ট করছে। অনেকেই এখন ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে সোনার দিকে পা বাড়াচ্ছে।
ETF এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়
বিশ্বের বড় বড় ফান্ড হাউসগুলি এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কগুলি তাদের পোর্টফোলিওতে এখন প্রচুর পরিমাণে সোনা মজুদ করে রাখছে। ফলে বড় অংকের টাকা গোল্ড মার্কেটে প্রবেশ করছে।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
বর্তমানে ব্যাঙ্কের আর্থিক প্রতারণা কিংবা ঋণের সংকট অর্থনীতির অনিশ্চয়তা দিনের পর দিন বাড়াচ্ছে। আর এরকম অবস্থায় সোনা নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে ধরা দিচ্ছে।
মন্দার আশঙ্কা
বিশ্বজুড়ে মন্দার ভয়ও তীব্র গতিতে বাড়ছে। যখন অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হচ্ছে, তখন বিনিয়োগকারীরা নগদ অর্থ কিংবা স্টকের বদলে সোনাতেই ভরসা রাখছে।
ভারতের ক্রেতাদের চাহিদা
এদিকে ভারত সোনার সবথেকে বড় ক্রেতা দেশগুলির মধ্যে একটি। কারণ পূজো কিংবা বিয়ে বা যে কোনও অনুষ্ঠানে সোনার চাহিদা একেবারে তুঙ্গে থাকে। আর এই মরসুমে চাহিদা আরও বাড়ার ফলে দাম ঊর্ধ্বগতিতে ঠেকে।
আমেরিকার ঋণ সংকট
মার্কিন সরকারের বিপুল পরিমাণে ঋণ এবং তার সুদের বোঝা বিশ্ব অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে তুলছে। আর এর ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে এখন সোনার দিকে পা বাড়াচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা
সোনা বরাবরই মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষিত বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, যখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে, তখন সোনার দামও বাড়ে। ফলে এটি ক্রমশ মূল্যবান সম্পদে পরিণত হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ নোবেল শান্তি পুরস্কার উঠল ভেনিজুয়েলার বীরাঙ্গনার হাতে! কে এই মারিয়া কোরিনা মাচাদো?
সাপ্লাই চেইনে সমস্যা
গোটা বিশ্বজুড়ে পরিবহন ব্যয় এবং খনিজ আহরণে জটিলতা দিনের পর দিন বাড়ছে। আর এতে সোনার উৎপাদন এবং পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা এর দাম বাড়াচ্ছে।
ডলারের দুর্বলতা
ডলারের দাম যদি কমে, তাহলে সোনা আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগের বিকল্প হয়ে ওঠে। কারণ তখন অন্যান্য মুদ্রার দেশগুলির জন্য সোনা কেনা সস্তা হয়। আর সে কারণেই সোনার চাহিদা বারছেন এবং দাম ঊর্ধ্বগতিতে ঠেকছে।